বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৮): অন্তহীন যুদ্ধ

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

যুদ্ধ নিয়ে অনেক দিন কথা বলা হয় না। চারিদিকে যখন যুদ্ধের দামামা তখন না হয় যুদ্ধ নিয়েই আজ কথা বলা যাক। আমার জীবনে প্রথম যুদ্ধ আসে ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। তখন ছোট ছিলাম, তবে যুদ্ধের ভয়াবহতা ঠিকই বুঝতে পারতাম। সেটা ছিল এক অন্তহীন ভয়ের সময়। মা প্রায়ই বলতেন ঝড় শেষ হয় কিন্তু যুদ্ধের কোন শেষ নেই। এখন মনে হয় সেটাই সত্য। মানব সভ্যতার ইতিহাস যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস। যুদ্ধ একদিকে যেমন ধ্বংস করে, অন্যদিকে সৃষ্টিও করে অনেক কিছুই। আজ সেসব কথাই বলব। যুদ্ধের কথা মনে হলেই মনে পড়ে ছোটবেলায় পড়া রামায়ণের গল্প।  বিশেষ করে লঙ্কা কাণ্ডের গল্প যখন রাম লক্ষণের সাথে রাবণ বা ইন্দ্রজিতের যুদ্ধ চলত। একপক্ষ অগ্নি বাণ নিক্ষেপ করলে অন্য পক্ষ বরুণ বাণ নিক্ষেপ করে সেই আগুন নেভায়। বৃষ্টির হাত থেকে নিজের সৈন্যদের রক্ষা করতে রাক্ষসরা যদি পবন বাণ ছুঁড়ে মেঘ উড়িয়ে দেয় রাম লক্ষণ তখন পাহাড় বাণ দিয়ে সেই ঝড় ঠেকায়। আজ যখন এস ৪০০ বা প্যাট্রিয়ট প্রতিপক্ষের রকেট ধ্বংস করে তখন রামায়ণের সেই যুদ্ধের কথাই মনে পড়ে। আবার মহাভারতে কর্ণের হাতে দেখি অর্জুনকে বধ করার দিব্য অস্ত্র। আজকের আরেশ্নিক বা অন্যান্য অস্ত্র যা প্রায় নির্ভুল ভাবে লক্ষ্য ভেদ করে তখন এদের দিব্যাস্ত্র থেকে কম কিছু মনে হয় না। আসলে এরোপ্লেন থেকে শুরু করে আধুনিক রকেট, বিভিন্ন মারণাস্ত্র এসবই এক সময় কবি আর লেখকদের কল্পনায় দেখা দিয়েছিল যা তাঁরা অতি যত্নে লিখে রেখে গেছেন উত্তরসূরিদের জন্য। এত গেল গল্পের কথা। কিন্তু যুদ্ধের ইতিহাস কী বলে? কথিত আছে সম্রাট অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধের আগে রাজপথ তৈরি করেছিলেন যাতে তাঁর হস্তী বাহিনী অনায়াসে যুদ্ধক্ষেত্রে আসতে পারে। এটা আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও বেশি আগের কথা। আর বর্তমান কালে তো বিজ্ঞান আর যুদ্ধ হাতে হাত রেখে চলে। আর্কিমিডিস থেকে শুরু বর্তমান যুগের প্রায় সব বিখ্যাত বিজ্ঞানী যুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বিশ্ব বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীদের হাতেই তৈরি হয়েছে পারমাণবিক বোমা। তবে বোমার সাথে এসেছে প্রযুক্তি যা আমাদের জানার পরিধি বাড়িয়েছে শত সহস্রগুণ। মনে হয় এ কারণেই প্রাচীন কালে অন্যান্য দেবতার পাশাপাশি যুদ্ধের দেবতারও পূজা হত।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় রকেট টেকনোলজি তেমন উন্নত ছিল না, কিন্তু তখনই মানুষ বুঝতে পারে এর কার্যকারিতা। ফলে অচিরেই শুরু হয় মহাকাশ জয়ের অভিযান। সোভিয়েত ইউনিয়ন  আর আমেরিকা নামে এক নতুন দৌড়ে – মহাকাশকে কে আগে পদানত করবে সেটাই ছিল এই প্রতিযোগিতার মূল কথা। ধীরে ধীরে রকেট চলে যাবে আকাশের বুক ভেদ করে, ইউরি গাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে পা রাখবেন আকাশের বুকে আর নীল আর্মস্ট্রং হেঁটে বেড়াবেন চন্দ্র পৃষ্ঠে।  এখানেই সব শেষ হবে না। মানুষ আর পৃথিবীর বুকে বসে দূরবীনে চোখ রেখে মহাকাশের রহস্য খুঁজবে না, প্ল্যাঙ্ক, চন্দ্র, জেমস ওয়েব একের পর এক মহাকাশ যাত্রা করবে আমাদের দূর আকাশের ছবি পাঠাতে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে মানব জাতির প্রয়াসকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে। তবে আমার উদ্দেশ্য শুধু যুদ্ধের গুণগান গাওয়া নয়, এর ভিন্ন দিকটা দেখানো। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ভেতর থেকে দেখলেও বয়সের কারণে অথবা আমাদের যুদ্ধের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেক কিছু হয় ছিল না, না হয় জানা  হয়নি। এটা ঠিক সেই যুদ্ধেও দেশের প্রায় সবাই কোন না কোন পক্ষে অংশ নিয়েছে। যারা সরাসরি যুদ্ধ করেনি তারাও এপক্ষ বা ও পক্ষকে কোন না কোন ভাবে সাহায্য করেছে। তবে বেশির ভাগ মানুষই ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সাহায্য ছিল আশ্রয় দেয়া আর শত্রুদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য দেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশে তখন এমন কোন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হত না যেখানে দেশের মানুষ ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারত। সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার পর যুদ্ধের গল্প শুনে বা পড়ে এবং সিনেমা দেখে মানুষের সম্পৃক্ততার কথা প্রথম অনুভব করি। তখন মনে হয় এদেশে খুব কম মানুষই ছিল যারা যুদ্ধে অংশ নেয়নি। একটি বিখ্যাত স্লোগান ছিল – সব কিছু ফ্রন্টের জন্য, সব কিছু বিজয়ের জন্য। পুরুষেরা যুদ্ধ করেছে, মহিলারা যুদ্ধের সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে কাজ করে গেছে। সেই যুদ্ধের সময়ই তৈরি হয়েছে টি-৩৪ এর মত ট্যাঙ্ক যা যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধ পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল যুদ্ধের বছরগুলোতেই।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৭): দূর থেকে আজকের বাংলাদেশ    - বিজন সাহা

আজ আমরা প্রায়ই বিভিন্ন দেশের অখণ্ডতার কথা বলি। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও স্থায়ী সীমানা বলে কোন ধারণা হয়তো ছিল না। নদীর স্রোত যেমন তীর ভাঙে অন্তহীন যুদ্ধ-বিগ্রহ তেমনি ভাঙ্গত দেশ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিপুঞ্জ গঠিত হলে বিভিন্ন দেশের সীমানা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, তবে সেটা বেশিদিন টিকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আবার সব নতুন করে শুরু হয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বিভিন্ন দেশের সীমানা আবার তাসের ঘরের মত ভাঙতে শুরু করে। তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের থাবা গোটানোর আগে ইচ্ছে মত সীমানা তৈরি করে যার ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এরপর শুরু হয় যুগোস্লাভিয়ার রক্তক্ষয়ী ভাঙ্গন। সেখানেই শেষ নয়। পশ্চিমা বিশ্ব সার্বিয়া ভেঙ্গে সৃষ্টি করে কসোবা। তাই বর্তমানে যখন বিভিন্ন সময় পশ্চিমা বিশ্ব কোন কোন দেশের সীমান্তকে চিরন্তন বলে ঘোষণা করে সেটা আসলে এক ধরণের ধোঁকা। কারণ তাদের সব কথাই শুধু সেই সব দেশের জন্য প্রযোজ্য যারা তাদের পেয়ারের, তাদের অনুগত। কেউ স্বাধীনচেতা হলেই এসব আইন কানুন বালির বাধের মত ভেঙ্গে পড়ে।  ফলে যুদ্ধ অনভিপ্রেত হলেও সেটা আমাকে অবাক করে না। যুদ্ধ একটা ব্যবসা, খুব লাভজনক ব্যবসা। তাই কারো উস্কানিতে যুদ্ধ লাগানোর আগে যেকোনো দেশের নেতাদের দুইবার ভাবা উচিৎ।

ইদানিং কালে প্রায়ই শোনা যায় ইউক্রেন যুদ্ধ আলোচনার মাধ্যমে থামিয়ে দেবার কথা। বিশেষ করে ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে। কিন্তু যুদ্ধ তো প্রাইভেট কার নয় যে মুহূর্তেই ব্রেক কষে থামিয়ে দেওয়া যায়। যুদ্ধ এক বিশাল রেলগাড়ির মত ব্রেক কষার পরেও যা ইনারশিয়ায় মাইলের পর মাইল চলতে পারে। নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে চাইলেই কি এই যুদ্ধ থামিয়ে দেয়া যাবে? প্রথমত ইউক্রেন যুদ্ধ আমেরিকান মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন প্রাণ জুগিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ চাকরি পাচ্ছে। অনেক দেশ নতুন করে অস্ত্র তৈরি শুরু করেছে। এই লাভের ব্যবসা কি এত সহজেই বন্ধ করা যায়? কিন্তু এটা তো শুধু আমেরিকায়ই ঘটছে না। অনেক দেশেই ঘটছে। যদিও রাশিয়ায় এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই বিখ্যাত স্লোগান নেই – তবে এখন এদেশের সব কিছুই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঘটছে। অসংখ্য নতুন কারখানা তৈরি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেসব জায়গায় কাজ করছে। তাদের সবাই যে অস্ত্র তৈরি করছে তা নয়, অনেকেই ফ্রন্টে অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেমন তেমনি করে এখন রাশিয়া আবার জেগে উঠেছে। বেকারত্ব কমেছে। এই যে হাজার হাজার তরুণ যুদ্ধে যাচ্ছে সেটা শুধু দেশপ্রেমের কারণেই নয়, ভালো উপার্জনের জন্যও। যুদ্ধ শেষ হলে এদের জন্য কর্ম সংস্থান করতে হবে। সেটা কি এতটাই সহজ? যুদ্ধকে কেন্দ্রও করে সমাজের সর্বস্তরে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটাকে ধরে রাখতে হবে। এই বিশাল শক্তিকে ধ্বংসের পথ থেকে সৃষ্টির পথে চালিত করতে হবে। সেটা কি এতই সহজ। যদি উল্টো হয়? এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বরিস পলেভইয়ের মানুষের মত মানুষেরা ছিলেন হিরো, আজ সেই হিরো যারা ড্রোন চালনা করে তারা, যাদের সেদিন আমরা অনলাইন ট্যাঙ্ক বা এ ধরণের খেলার খেলোয়াড় মনে করতাম। এখন ড্রোন শুধু যুদ্ধই করে না, যুদ্ধক্ষেত্রে খাবার দাবার, ওষুধপত্র সরবরাহ করে। এর অর্থ যুদ্ধ শেষে বেসামরিক জীবনে এদের ব্যবহার বাড়বে। সেটা কি চাকরির সমস্যা সৃষ্টি করবে না? তাই আমার মনে হয় যুদ্ধ শুরু যেমন সমস্যা এর শেষ কম সমস্যার নয়। এটা অনেকটা ছাত্র জীবনের মত। আমরা পড়াশুনা করে পাশ করতে চাই, পাশ করে আনন্দিত হই কিন্তু এরপর যদি চাকরি না পাই বা জীবিকা নির্বাহের উপায় খুঁজে না পাই সেই আনন্দ বেশি দিন থাকে না। তারপরেও যুদ্ধ শেষ করতেই হবে। কারণ যত দিন যাবে যুদ্ধ একটু একটু করে ঘরে ঢুকতে শুরু করবে। তবে এখানে শেষ হলেও যুদ্ধ অন্য ফ্রন্টে চলবে। সেটা কি? হতে পারে সিরিয়া, হতে পারে আমাদের অঞ্চল। বিশেষ করে যদি ভারত আর চীনের মধ্যে নতুন করে অবিশ্বাসের বীজ ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবে ব্রিকসের অগ্রগতি কিছু সময়ের জন্য হলেও থামিয়ে দেয়া যাবে। এ বিষয়ে অন্য কোন সময়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো