বাংলাদেশ ‘ইন্টারনেট ট্রানজিট’ না দিলে ভারতের সেভেন সিস্টার্স কি সমস্যায় পড়বে?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের মানোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ থেকে কেবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট দেওয়ার যে দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি নেওয়া হয়েছিল, তা থেকে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বা বিটিআরসি। ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একাংশে এই খবর প্রকাশ হওয়ার পরে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মহলে।
ওই প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সমুদ্রের নিচ দিয়ে আসা কেবল বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের ল্যান্ডিং স্টেশনে আসার পরে সেখান থেকে ত্রিপুরা হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দ্বিতীয় একটি সংযোগ দেওয়ার কথা ছিল। তবে ২০২১ সাল থেকে চালু হওয়া প্রথম ইন্টারনেট সংযোগটি অবশ্য এখনও চালু আছে।
ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন বাংলাদেশ যদি সত্যিই বাড়তি ব্রডব্যাণ্ড ইন্টারনেটের প্রস্তাবিত সংযোগটি না দেয় তাহলেও উত্তরপূর্ব ভারতের তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের উন্নয়নে বিশেষ প্রভাব পড়বে না।
ভারতের নিজস্ব যা ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ আছে, তা ওই অঞ্চলের জন্য এখনও যথেষ্ঠ বলেই মনে করছে বণিক-মহল। আবার ব্যান্ডউইডথের চাহিদা বাড়লে তা সামাল দেওয়ার জন্য নিজস্ব পরিকল্পনা অনেক বছর আগেই থেকেই করা আছে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের কথায় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত ব্রডব্যাণ্ড সংযোগটি ছিল একটি ‘বিকল্প মাত্র’।
কী ছিল প্রস্তাবে?
ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত সংবাদপত্র দ্য ইকনমিক টাইমসের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী সামিট কমিউনিকেশন এবং ফাইবার@হোম – এই দুটি বেসরকারি বাংলাদেশি সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন, বিটিআরসির কাছে আবেদন জানানোর পরে কমিশন সে দেশের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণায়ের কাছে প্রকল্পটির বিষয়ে অনুমোদন চেয়েছিল।
সিঙ্গাপুর থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত ব্যান্ডউইডথ পৌঁছনোর কথা ছিল, সেখান থেকে ভারতের টেলিকম সংস্থা ভারতী এয়ারটেল সেই সংযোগ উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নিয়ে যাবে – এমনটাই ছিল প্রস্তাব।
বিটিআরসি-র সূত্র উদ্ধৃত করে দ্য ইকনমিক টাইমস লিখেছে যে “ওই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নিজেরই একটি আঞ্চলিক ইন্টারনেট হাব হয়ে ওঠার সম্ভাবনাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।”
বাংলাদেশকে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসাবে ব্যবহার করে ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মনিপুর, মেঘালয় এবং নাগাল্যাণ্ডে দ্রুতগতির ইন্টারনেট আরও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হত ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে।
ঢাকার ‘ডেইলি স্টার’ একটি প্রতিবেদনে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এমদাদুল বারিকে উদ্ধৃত করেছে এভাবে: “গাইডলাইন এধরণের ‘ট্রানজিট’ ব্যবস্থা অনুমোদন করে না।”
ওই একই রিপোর্টে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের যে দুটি বেসরকারি সংস্থা সিঙ্গাপুর থেকে আসা কেবল আখাউড়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল, তারই অন্যতম সামিট কমিউনিকেশনসের চেয়ারম্যন হলেন মুহাম্মদ ফরিদ খান, যিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক খানের ছোট ভাই।
সমস্যায় পড়বে উত্তর-পূর্ব ভারত?
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে তথ্য প্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলার জন্য ভারত সরকার নানা প্রকল্প নিয়েছে গত কয়েক বছরে।
প্রতিটি রাজ্যে যেমন গড়ে তোলা হয়েছে সফ্টওয়্যার পার্ক, তেমনই আসামে বড় বড় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থা গড়ে তুলছে তাদের নিজস্ব পরিসর।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল টাটা গোষ্ঠীর প্রায় ২৭ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করে সেমিকন্ডাক্টর কারখানা গড়ে তোলার প্রস্তাব।
ভারত সরকারের উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম ‘হাইপার স্কেল ডেটা’ সেন্টার ‘সিটিআরএলএস’ আসামে একটা বৃহৎ ডেটা সেন্টার গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতের সরকারি ন্যাশনাল ডেটা সেন্টারও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য পৃথক ডেটা সেন্টার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে ২০২১ সালে।
এছাড়াও ড্রোন তৈরির শিল্প, সফ্টওয়্যার নির্মাণের মতো নতুন শিল্পকেন্দ্র সেখানে গড়ে উঠছে।
তথ্য প্রযুক্তি শিল্প যত বাড়বে, ততই ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইডথের প্রয়োজন হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাবিত দ্রুতগতি ইন্টারনেট সংযোগ যদি এখন আর নাই পাওয়া যায়, তাহলে কতটা সমস্যায় পড়তে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্রমবর্ধমান তথ্য প্রযুক্তি শিল্প?
ভারতের এক শীর্ষ বণিক সভার কর্মকর্তা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলছিলেন, “বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাবিত সংযোগ না এলে কোনও সমস্যাই হবে না কারণ এই অঞ্চলের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়ন হলেও সেখানে বিপিও-র মতো সংস্থা – যাদের নিরবচ্ছিন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রয়োজন, তা এখনও সংখ্যায় কমই আছে।”
যদিও বিপিও গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দিচ্ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, যার জন্য আর্থিক সহায়তাও করা হয়।
কলকাতা থেকে আসামের গুয়াহাটিতে নিজের সফ্টওয়্যার রফতানি ব্যবসার একটা বড় অংশ সরিয়ে নিয়ে গেছেন ‘সোমনেটিক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কার্যনির্বাহী অফিসার শান্তনু সোম।
তিনি বলছিলেন, “গত আট থেকে দশ বছরের মধ্যে উত্তর পূর্বাঞ্চলে রাস্তাঘাট সহ নানা পরিকাঠামোর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। টাটা গোষ্ঠীর বিনিয়োগ এবং অন্যান্য তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্পগুলি সেখানে বড়সড় বিনিয়োগ করছে। আবার একটা বড় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম রয়েছে, যারা তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী। তাই প্রচুর নতুন চাকরির সুযোগ সেখানে তৈরি হবে কিছু দিনের মধ্যে।”
“এই নতুন চাকরিগুলো যখন তৈরি হয়ে যাবে, তারা সবাই যখন ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে কাজ করতে শুরু করবে তখন বাড়তি ব্যান্ডউইডথের প্রয়োজন হবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। তবে এই মুহূর্তে ব্যান্ডউইডথের সমস্যা সেখানে নেই। আমাদের নিজেদের যে কেন্দ্রটি রয়েছে গুয়াহাটির সফ্টওয়্যার ডেভেলপমেন্ট পার্কে, সেখানে খুবই দ্রুতগতির ইন্টারনেট পাই আমরা,” বলছিলেন মি. সোম।
তার কথায়, “অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ভাল ব্যান্ডউইডথ যদি পাওয়া যায়, সেটার প্রস্তাব ছিল। সেটা থেকেই এখন পিছিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। কেন সেই প্রস্তাব থেকে পিছিয়ে গেল, সেটা তো বাংলাদেশ সরকারের বিষয়।”
বিশ্লেষক প্রতিম রঞ্জন বসু বলছিলেন, “নিশ্চই বাড়তি ব্যাণ্ডউইডথ দরকার পড়বে উত্তর-পূর্ব ভারতে।কিন্তু তার জন্য শুধুই বাংলাদেশের ওপরে নির্ভর করে এত বড় পরিকল্পনা তো করা হয়নি!”
“ইতিমধ্যেই চালু সংযোগগুলো তো আছেই, এর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দীঘাতে যে কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকেও তো দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে, আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তরপূর্ব ভারত তো একেবারেই কাছে! তাই কোনও কারণে বাংলাদেশ থেকে সংযোগ না পাওয়া গেলেও উত্তরপূর্ব ভারত কোনও সমস্যায় পড়বে না বলেই আমার ধারণা।”
দুই দেশের প্রথম ইন্টারনেট সংযোগটি চালু আছে
ভারতের ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ নেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ পুরোদমে আসা শুরু হয় ২০২১ সালে। সেই ব্যবস্থাপনা অবশ্য দুই দেশের দুটি সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
ত্রিপুরার কেন্দ্রটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে।
ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পাঁচই ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী বহির্বিশ্বের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগের জন্য দেশের পাঁচটি শহরে ১৪টি কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন আছে যেগুলিতে সমুদ্রের নিচ দিয়ে আসা ১৭টি কেবল ভূপৃষ্ঠে এসে উঠেছে। আর সেখান থেকে সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগকারী ফাইবার অপটিক কেবল ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই উত্তর পূর্ব সহ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের ইন্টারনেটের মূল সংযোগ।
এগুলি ছাড়াও আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আর লাক্ষাদ্বীপের জন্য পৃথক ভাবে সমুদ্রের নিচ দিয়ে নিজস্ব ইন্টারনেট কেবল সংযোগ গড়ে তুলেছে ভারত সরকার।
আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংযোগের ১৪টি ল্যান্ডিং স্টেশন ছাড়া নতুন করে আরও তিনটি ল্যান্ডিং স্টেশন গড়ে উঠছে, যার মধ্যে একটি তৈরি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দীঘায়।
ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক কেবল ল্যান্ডিং স্টেশনগুলির মাধ্যমে ১১১ টিবিপিএসেরও বেশি (টেরাবাইট প্রতি সেকেন্ড) ডেটা চলাচল করে।
একটি সর্বভারতীয় শীর্ষ বণিক সভার এক কর্মকর্তা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “এখন বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের যে চালু ইন্টারনেট সংযোগটি রয়েছে ত্রিপুরার মাধ্যমে, সেটা মাত্র ১০ জিবিপিএস লাইন। উত্তর-পূর্ব ভারতের যে ব্যান্ডউইডথের দরকার, তার একটা ভগ্নাংশ ওই লাইনটির মাধ্যমে আসে বাংলাদেশ থেকে। বাকি যে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ দরকার, সেটা তো নানা সংযোগের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন দিক থেকেই আসে, সেই পরিকাঠামো রয়েছে এই অঞ্চলে।”
“ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইন্টারনেট পরিকাঠামো যখন অতটা নিবিড়ভাবে গড়ে ওঠেনি, সেই সময়ে বাংলাদেশের ওই লাইনটি কাজে লেগেছে। কিন্তু এখন ভারতের নিজস্ব ইন্টারনেট পরিকাঠামো উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে পৌঁছিয়ে গেছে,” বলছিলেন শিল্প-বাণিজ্য বিশ্লেষক প্রতিম রঞ্জন বসু।
গাছের ওপরে মোবাইল হাতে
একটা সময়ে ইন্টারনেট সংযোগ কেন, মোবাইলের সিগনাল পাওয়াও কষ্টসাধ্য ছিল উত্তর-পূর্বের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারি বিএসএনএলের মোবাইল সংযোগ ছাড়া অন্য কোনও সংস্থার মোবাইল সংযোগ ব্যবহারই করা যেত না। ইন্টারনেট ছিল আরও দুর্বল।
“আমি আসামের তিনসুকিয়ার এক চা বাগানের ম্যানেজারকে ২০১৬ সালে দেখেছিলাম গাছের ওপরে মোবাইল-সহ একজন কর্মীকে বসিয়ে রাখতে। একমাত্র গাছের ওপরেই মোবাইলের সিগনাল পাওয়া যেত। কিছুদিন আগে আমি ওই অঞ্চল দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক নাগাড়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে করতে গেছি – এতটাই উন্নত হয়েছে কানেক্টিভিটি,” বলছিলেন শিল্প-বাণিজ্য বিশ্লেষক প্রতিম রঞ্জন বসু।
তার কথায়, “এখন প্রতিটা রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অপটিকাল ফাইবার কেবল বসে গেছে।ন্যাশনাল অপটিকাল ফাইবার মিশনের অধীনে সরকারি আর বেসরকারি সংস্থাগুলো মোটামুটিভাবে ইন্টারনেটের জাল ছড়িয়ে দিয়েছে উত্তরপূর্বের সর্বত্র।”
“বাংলাদেশ থেকে যে আরেকটি লাইন আনার পরিকল্পনা হয়েছিল, সেটা ছিল ব্যাকআপ। যদি কোনও কারণে উত্তরপূর্বের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, তাহলে যাতে সেখানে কাজ থেমে না থাকে তাই বাংলাদেশ থেকে নতুন সংযোগটি আনার কথা ভাবা হয়েছিল। ওই প্রস্তাবিত সংযোগের ওপরে আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল কখনই হইনি। বিকল্প পথ ছিল এটি, মূল সংযোগ অটুটই আছে,” বিবিসি বলছিলেন মি. বসু।