বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৮১): জন্মভূমি

– বিজন সাহা

ভালবাসাই হোক আর ঘৃণাই হোক – সেটা যখন অন্ধ হয় তখন যারা অন্ধভাবে ভালবাসে বা ঘৃণা করে তাদের অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি। আমার মনে হয় বাংলাদেশে এখন সেটাই ঘটছে। ইতিমধ্যে জুলাই আগস্টের বিপ্লবীদের মুখোস খুলতে শুরু করেছে বা সঠিক ভাবে বললে এরা এখন একটু একটু করে নিজেদের মুখোস খুলে আসল চেহারা প্রদর্শন করছে। করছে বেশ উল্লাসের সাথেই। এর মধ্য দিয়ে তারা শুধু পরাজিত স্বৈরাচারকেই কটাক্ষ করছে না, এত দিন যারা তাদের দোসর ছিল তাদের প্রতিও বাঁকা হাসি হাসছে। অনেকেই নিজেদের ভুল স্বীকার করছে কিন্তু অতি চালাকরা বিভিন্ন ভাবে নিজেদের ভূমিকাকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে গিয়ে নব্য রাজাকারদের হাত শক্তিশালী করছে। আজ যখন সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে মুজিবের সংবিধান কবর দেবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে বা জুলাই আগস্টের বিপ্লবের পেছনে জামাতের বিরাট ভূমিকার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করা হচ্ছে তখন আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো আদৌ রাজনৈতিক দল কি না, এসব দল দেশের রাজনীতি সম্পর্কে আদৌ কোন সিরিয়াস গবেষণা করে কি না? আমি বলব না যে এই বিপ্লবের পেছনে যে জামাত শিবিরের হাত আছে সে সম্পর্কে আমার সঠিক ধারণা ছিল। তবে সেই সময় সরকার একাধিক বার এটা বলেছে আর বিরোধী দলগুলো এটাকে সরকারি প্রচারণা বলে কোন রকম গুরুত্ব দেবার দায়িত্ব বোধ করেনি। তবে জামাত শিবিরের হাত থাকুক আর নাই থাকুক বিপ্লবের ফসল যে তাদের ঘরে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এ নিয়ে আমি জুলাই ও আগস্টে বিভিন্ন স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম। আমার যুক্তি ছিল অন্য রকম। সেই সময়ে, এমনকি এখনও দেশে রাজনীতি বলে কিছু নেই। জিয়াউর রহমানের নির্দেশ অনুসরণ করে আওয়ামী লীগ দেশে রাজনীতি করাকে কঠিন করে তুলে। ফলে শুধু বিরোধী দল নয়, এক সময় আওয়ামী লীগ নিজেও অরাজনৈতিক এক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় যার কাজ ছিল ম্যান্ডেট বিক্রি করা আর জুয়া খেলার স্টাইলে নিজের প্রার্থীদের জয়ী করে আনা। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর তথৈবচ অবস্থা সেক্ষেত্রে সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী জামাতের পক্ষেই ক্ষমতা দখল সম্ভব। তাই আমি লিখেছিলাম, সরকার যখন ছাড় দিতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ সুস্থভাবে রাজনীতি করার পরিবেশ তৈরি করতে এবং কয়েক মাসের মধ্যে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করা। কারণ স্বৈরাচারকে বিদায় করা শেষ গন্তব্য হতে পারে না, শেষ গন্তব্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর সেটাই যদি লক্ষ্য হয় তবে স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী সময়ে নিজেদের শক্তির সঠিক বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি সিপিবি বা দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে কখনোই দেশের নীতিনির্ধারণী শক্তি হিসেবে দেখিনি। কারণ তারা আইসবার্গের ভেসে থাকা অংশ নয়, যা দৃশ্যমান – এটাই এদের সব, নীচে খুব একটা কিছু নেই। একটা সময়  বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরা অক্সিজেন হিসেবে কাজ করেছে, বিশেষ করে যখন নিষিদ্ধ বা আত্মগোপনে ছিল। তখন এরা ন্যাপ এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও কাজ করেছে ঠিক এখন যেমন জামাত শিবিরের কর্মীরা করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঢুকে। কিন্তু এদের বর্তমান কার্যকলাপ দেখে মনে হয় বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কার্বনডাইঅক্সাইডের মত। শুধু পরিমানেই কম নয় টক্সিকও বটে। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভিন্ন সময়েই ভুল পথে চলেছে। তার মূল কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তারা স্থানীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ শোষণ মুক্ত সমাজ তৈরির জন্য আবশ্যক, কিন্তু সেটাকে স্থানীয় বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে প্রয়োগ করতে না পারলে এই রাজনীতি শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে যাবে, বাস্তবে পরিণত হবে না।

জুলাই আগস্টের বিপ্লব যে সুপরিকল্পিত ছিল সেটা এর বর্তমান নেতারা নিজেরাই স্বীকার করছে। রাজনৈতিক আন্দোলন সুপরিকল্পিত হবে তাতে সমস্যা নেই। সমস্যাই হয় তখনই যখন এর মূল উদ্দেশ্য জনগণের কাছ থেকে গোপন রেখে জনগণকে ব্যবহার করে আন্দোলনে সফল হয়ে নিজেদের ভোল পাল্টানো হয়। অন্তত এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজনীতি কমবেশি স্বচ্ছ ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে ৭ মার্চ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও সম্মিলিত জোট আন্দোলন পরবর্তী রূপরেখা আগে থেকেই প্রকাশ করে। সেদিক থেকে দেখলে কোটা সংস্কার, স্বৈরাচারের অবসান, দুর্নীতি দমন ও স্বজনপ্রীতি নিশ্চিহ্ন করার স্লোগান আজ শুধুই স্লোগান। আজ সমন্বয়করাই বলার চেষ্টা করছে যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কখনোই নির্বাচনের জন্য ছিল না। তাদের বিভিন্ন কথাবার্তাই প্রমাণ করে যে সমগ্র আন্দোলনটাই ছিল এক বিশাল চক্রান্ত এবং সেটা যতটা না স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তারচেয়ে বেশি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, সেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যার জন্য একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে, দুই লক্ষ মা বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। শুধুমাত্র আওয়ামী বিরোধিতা করতে গিয়ে একাত্তরের পক্ষের অনেক পরীক্ষিত শক্তিও আজ সেটাকে এনডোরস করছে অথবা কোন এক অজ্ঞাত কারণে মৌনব্রত পালন করছে। ফলে কী হয়েছে? শুধু ক্ষমতাসীন মানুষের চেহারা বদলিয়েছে কিন্তু ক্ষমতার চরিত্র বদলায়নি। জনগণকে আবারো ধোঁকা দেয়া হয়েছে, হচ্ছে। নিজেদের ক্ষমতা বজায় রাখতে শুরু হয়েছে সংবিধান পরিবর্তনের নাটক। প্রস্তাব আসছে ভোটারদের বয়স ১৭ বছরে নামিয়ে আনার আর ২১ বছর থেকে নির্বাচিত হবার অধিকার দেবার। বলতে বাধা নেই যে এটা হচ্ছে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের ক্ষমতা গ্রহণের পথ কন্টকমুক্ত করার জন্য। আর বিগত ১৫ বছরের আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসনের দোহাই দিয়ে নিজেদের বর্তমান ব্যর্থতাকে জায়েজ করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সব কিছুরই ভালো ও মন্দ দুটো দিকই থাকে। সাপের বিষও ওষুধ হয় সঠিক প্রয়োগে। বিগত সরকারের প্রচুর ব্যর্থতা ছিল সেটা যেমন তর্কাতীত, ঠিক তেমনি তার সাফল্যও কম নয়। তার শত শত মডেল মসজিদ তৈরি যেমন সমাজকে পেছন দিকে টেনে নিয়েছে পাশাপাশি প্রচুর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন একদিন দেশকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে বলেই মনে হয়। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর পাশাপাশি বাচ্চাদের বিনামূল্যে বই ও সবার জন্য পেনশন এগুলোর কি মোটেই গুরুত্ব নেই? বিগত সরকারের সময় বছরের প্রথম দিনে বিভিন্ন ধরণের শুভেচ্ছা বাণীর সাথে আরও যে জিনিসটা ফেসবুকের পাতা ভরিয়ে রাখত তা হল নতুন বই হাতে শিশুদের হাসি মুখ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচুর ব্যর্থতার মধ্যেও বিতাড়িত সরকারের যেসব সাফল্য ছিল, বিনামূল্যে বই বিতরণ তার অন্যতম। এবার শুনলাম সবার হাতে বই পৌঁছায়নি। এটা শিশুদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি মনস্তাত্ত্বিক আঘাত। বই পেতে নাকি মার্চ মাস গড়িয়ে যেতে পারে। অনেক পুস্তক নতুন করে লেখা হচ্ছে, নতুন করে লেখা হচ্ছে ইতিহাস। আসছে নতুন শহীদদের নাম। আচ্ছা এসব শহীদদের কেউ কেউ কি ইতিমধ্যেই জীবন ফিরে পেয়েছে? দেশের বর্তমান নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলো যতটা স্বৈরাচারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নিয়ে সরব, তার সাফল্যের ব্যাপারে ততটাই নীরব। অথচ বিনামূল্যে বই বিতরণ এটা সরকার নয়, জাতীয় জীবনে উল্লেখ করার মত ঘটনা। যারা জনগণের মঙ্গলের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুখে ফেনা তুলে বেড়ায় সময় মত বই বিতরণে সরকারি ব্যর্থতা তারা কি চোখে দেখে? যেখানে স্বাধীনতার মত অর্জন আজ প্রশ্নের সম্মুখীন সেখানে এসব ছোট খাটো অর্জন চোখের নিমেষে উধাও হয়ে যাবে যদি না জনগণ এখন থেকেই সোচ্চার হয়। মনে রাখতে হবে যে বিনামূল্যে বই বিতরণ, সবার জন্য পেনশন, গরীবদের মধ্যে ঘর বিতরণ ইত্যাদি প্রোগ্রাম বাতিল হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, গরীব মানুষ। যারা গরীবের জন্য রাজনীতি করে তারা এসব বিষয়ে কী ভাবছে? বইয়ের বিষয়ে একটি কথা না বললেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় সরকার থেকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হয়। প্রতি বছর পরীক্ষার শেষে নতুন ক্লাসে প্রমোশন পাওয়ার আগে সবাই স্কুলের লাইব্রেরীতে বই ফিরিয়ে দেয়। ফলে প্রতি বছর নতুন করে বই ছাপাতে হয় না, বেশ কয়েক বছর একই বই ছাত্রছাত্রীরা ব্যবহার করতে পারে। আমাদের ছোটবেলায় এরকম পুরানো বই কেনার রেওয়াজ ছিল, অনেকেই অর্ধেক মূল্যে পুরানো বই কিনত।

প্রশ্ন আসতেই পারে দেশ থেকে অনেক দূরে বসে, দেশের কর্মকাণ্ডে কোন রকম অংশ না নিয়ে আমরা এসবের সমালোচনা করার কে? অনেকেরই ভালোবাসার মানুষ থাকে। বিভিন্ন কারণে তাদের পথ দুদিকে বেঁকে গেলেও মনের গভীরে এসব মানুষের জন্য ভালোবাসা থেকে যায়। তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে ইচ্ছে করে, তাদের সাফল্যে খুশি আর ব্যর্থতায় ব্যথিত হয়। একই ভাবে অনেকের প্রিয় দল বা সংগঠন থাকে। বিভিন্ন কারণে দল করা না হলেও তারা দলের খবর রাখতে চায়, দলের সাফল্য বা ব্যর্থতা তাদের খুশি বা দুঃখী করে। তবে দল যেহেতু ব্যক্তি নয় তাই সেখানে আদর্শের প্রশ্ন আসে, প্রশ্ন আসে সেই আদর্শ ধারণ করার। আর যখন দল তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় তখন প্রাক্তন কর্মী বা সমর্থকরা তার প্রতিবাদ করে। কারণ দল না করেও আদর্শিক সেনা হওয়া যায়, কিন্তু আদর্শ বর্জন করে দল করা যায় না, অন্তত কমিউনিস্ট পার্টির নামে। মনে রাখতে হবে যে কমিউনিস্ট আন্দোলন কোন আঞ্চলিক আন্দোলন নয়, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অংশ। এর আছে ঐতিহ্যবাহী আইডিওলজি। আর এজন্যেই এই নাম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে পার্টিকে তার রণনীতি ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতু আমাদের অনেকেই বিশ্বাস করে যে সামাজিক বৈষম্য সম্পূর্ণ দূর করা না গেলেও জাতীয় সম্পদের যৌক্তিক বন্টন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অবস্থার আমুল পরিবর্তন সম্ভব এবং এখানে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তাই বর্তমান রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা আমাদের ব্যথিত করে। কারণ সব কিছুর পরেও বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। এ দেশের ভালো মন্দ আমাদের ভালো থাকার জন্যেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা যেখানেই থাকি না কেন।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো