বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৮২): বিকল্পধারা

-বিজন সাহা

কয়েক দিন আগে এক বন্ধু ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে আমাদের সবাইকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা তলে এক হবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি তখনই লিখেছিলাম পার্টির পতাকা বিমূর্ত কিছু নয়। যদিও এটা একটি নির্দিষ্ট আদর্শ বহন করে, কিন্তু যারা পার্টির নেতৃত্বে থাকেন তাদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্দিষ্ট সময়ে পার্টির চরিত্র কেমন সেটা নির্ভর করে। বিভিন্ন সময়ে পার্টির সাথে জড়িত থাকার পরেও এবং এখনও সমজতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করার পরেও অনেকেই পার্টি থেকে দূরে থাকেন – এর দায় অনেকটাই পার্টি নেতৃত্বের, বিগত দিনগুলোয় তাদের ভুল রণনীতি ও রণকৌশলের কারণে। তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ডেও অনেকে বিভ্রান্ত। বিগত কয়েক বছর ধরে তাদের অধিকাংশ কাজের ফল ভোগ করেছে তাদের আদর্শিক শত্রুরা।

বাংলাদেশের বর্তমান অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিকল্প শক্তির কথা আবার নতুন করে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তির উত্থান নিয়ে এই আলোচনা নতুন নয়। মনে হয় সেই আশির দশক থেকেই এই কথা চলছে। এরশাদের পতনের পর ধারণা করা হয়েছিল যে দেশ এখন গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে। গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউটগুলো এখানে বিকশিত হবে। কিন্তু সরকারি ও প্রধান বিরোধী দল দুটোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রচেষ্টায় বিরোধী দল সব সময়ই বিরোধীই থেকে গেছে, রাষ্ট্রের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করেনি পাছে সব ক্রেডিট সরকারি দল পেয়ে যায়। ফলে গনতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তথা গণতন্ত্র বিকশিত হয়নি। দেশ আওয়ামী ও বিএনপি এই দুই আন্টাগোনিস্টিক শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। এই আপদ ও বিপদের বিপরীতে দেশপ্রেমিক বিকল্পধারা গড়ে তোলার জন্য বাম ঐক্যের কথা বারবার সামনে চলে আসে। কিন্তু বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে বামেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া তো দূরের কথা উল্টো বিভাজনের মধ্যে দিয়ে অনু পরমানুর রূপ ধারণ করেছে। শুধু তাই নয় এদের স্পিন কোন দিকে – বামে না ডানে সেটা বুঝে ওঠা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। এখনও বিভিন্ন বাম দলের, বিশেষ করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতাদের বিভিন্ন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে মনে হয় দেশীয় রাজনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পার্টির ভেতরে মতৈক্য নেই। দ্বিমত বা বিভিন্ন মত থাকবে এটা অতি স্বাভাবিক। পার্টির ভেতরে এ নিয়ে আলাপ আলোচনা হবে, সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে পার্টি কোন একটি মত গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় লোকজনের কথাবার্তায় মনে হয় অনেক প্রশ্নেই তারা মতৈক্যে পৌঁছুতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি। শুধু তাই নয় সেটা বাইরে প্রকাশ করে নিজ নিজ সমর্থক বেজ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তাছাড়া সমস্যা আছে নেতৃত্ব নিয়ে। এটা আমাকে অনেকটা রাশিয়ায় দ্মিত্রি মেদ্ভেদেভের প্রেসিডেন্সির কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি প্রেসিডেন্ট হলেও সবাই তাকিয়ে থাকত পুতিনের দিকে। পুতিন কি বলেন। আমার মনে হয় একই ধরণের সমস্যা তৈরি হয়েছে পার্টির মধ্যে। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক এক ধরণের কাল্ট তৈরি হয়েছে পার্টির ভেতরেও। এখন নিজেদের ঘরই যদি ঠিক না থাকে তাহলে বৃহত্তর বাম ঐক্য কীভাবে গড়ে উঠবে, সেই ডাকে অন্যরা কেনই বা সাড়া দেবে?

ঠিক এসময়েই আরেক বন্ধু সমাজতন্ত্র নিয়ে স্ট্যাটাস দিলেন। উনি যে কখনও সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলন সেটা এই প্রথম জানলাম। তবে  ভারতীয় দর্শনের উপর ওনার পাণ্ডিত্য অগাধ। সম্পদের সুষম বন্টন নিয়ে উনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাই সেটাও এড়িয়ে যেতে পারলাম না। তাই লিখলাম সুষম বন্টন হয়তো সম্ভব নয় কারণ সেটা প্রায়ই ন্যায্যতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আপনি চাইলেই সব ছাত্রকে সমান নম্বর দিতে পারেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন সবাইকে প্রায় সমান বেতন দিয়ে সমাজে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। কারণ এতে সামাজিক ন্যায় বিচার ছিল না, ছিল দক্ষদের শ্রমে অদক্ষদের খাওয়ানো। এখানে সব শিশুর প্রায় সমান সুযোগ ছিল (প্রায় লিখলাম কারণ সব স্কুল এক রকম ছিল না, সব শিক্ষক এক রকম নন যা সব সময় সরকার বা সমাজ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে না, যেমন সব পিতা-মাতা এক রকম যত্নশীল নন – এটা প্রাকৃতিক) যেটা আমার পছন্দ হত। সবার সুযোগ ছিল যোগ্যতা বা মেধা অনুযায়ী নিজেকে বিকশিত করার। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা ভালো আর মন্দ বিশেষজ্ঞ সবাই যদি একই রকম বেতন পায় তাহলে আসলে মন্দকেই প্রশ্রয় দেয়া হয়। আর এই সব লোকেরা যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যাপারে আগ্রহী হয় দিনের শেষে ক্ষমতা চলে যায় অযোগ্য না হলেও সেই সব লোকের কাছে যারা সমাজে শেষ বেঞ্চের ছাত্রছাত্রী হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া পুঁজিবাদকে ঘৃণা করে এই সমাজে পুঁজির প্রতিও ঘৃণা জমেছিল। ভুলে গেছিল উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি না হলে বন্টন করার কিছু থাকবে না। আসলে রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ হতে হলে তাকে পুঁজিবাদী পথেই উৎপাদন করতে হবে আর সমান নয়, কাজের ফলাফল অনুযায়ী (যেমন কর্ম তেমন ফল) বেতন দিতে হবে, তবে কোন নাগরিক যাতে না খেয়ে না মরে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু এখানে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এসব ছিল সরকারের অধীনে, সেটা করা অসম্ভব ছিল না। সোভিয়েত সমাজে বসবাস, তার পতন প্রত্যক্ষ করা, পরবর্তীতে এখানে থেকে যাওয়া, কলিগ সহ বিভিন্ন মানুষের অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমার মনে হয় ওটা একটা মানবিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে। নিউটনের সূত্র কোয়ান্টাম বিশ্বে কাজ না করলেও যেমন সব কিছুর প্রাথমিক ভিত্তি, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও তেমনি প্রায় শোষণমুক্ত সমাজের প্রাথমিক ভিত্তি হতে পারে। ত্রুটিহীন কিছু নেই, তবে ত্রুটি যতদূর সম্ভব কমানোর চেষ্টাই বিজ্ঞান। আমাদের সমস্যা হল আমরা নিজেদের পথটাকে একমাত্র সফল পথ বলে মনে করি যদিও জানি সাফল্যের ধারণা সবার কাছে এক নয়। কিন্তু ক্ষমতার লড়াইয়ে বিজয়ীরা নিজেদের মত ও পথকেই সবার উপর চাপিয়ে দিতে চায়। সোভিয়েত ইউনিয়নেও সেটাই ছিল। সমস্ত শিশুদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিকশিত হবার যে অভূতপূর্ব ব্যবস্থা সেখানে তৈরি হয়েছিল, একই ভাবে যদি বয়স্ক ও বিশেষজ্ঞদের নিজের নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করে নিজের স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে দেশের সেবা করার সুযোগ করে দিত তাহলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হোক আর না হোক একটা সুখী ও সমৃদ্ধ সোভিয়েত সমাজ আজও টিকে থাকত বলেই আমার বিশ্বাস। সমস্যা হল আমরা মানুষের সুখের জন্য ধর্ম বা রাজনীতি শুরু করলেও এক সময় মানুষের চেয়ে ধর্মের অনুশাসন বা রাজনীতির আদর্শকেই মানুষের চেয়ে বড় করে দেখি। ফলে ধর্ম, তন্ত্র এসব সমাজের একটা অংশের কাছে স্বর্গসুখ হলেও অন্য অংশের কাছে নরকযন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। যেদিন সবার উপর মানুষ সত্য হবে কেবল সেদিনই ন্যায় ও সত্যের উপর ভিত্তি করে সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হবে তা সে যে নামেই হোক।

এমন ধারণা চালু আছে যে সমাজতন্ত্রের কোন তাত্ত্বিক ত্রুটি ছিল না, ত্রুটি ছিল প্রয়োগে। কিন্তু প্রায়োগিক ত্রুটি তখনই ঘটে যখন তত্ত্বের ভেতরে সেই ভুল করার সুযোগ থাকে। এটা অনেকটা আইনের বিভিন্ন ব্যাখ্যার মত। অর্থাৎ শুধু মাত্র প্রয়োগের ত্রুটি বললেই চলবে না, তত্ত্বে কোন ভুল ছিল কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া সময়ের সাথে পরিস্থিতি বদলায়, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে তত্ত্বকে সময়োপযোগী করতে হয়। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস আমাদের গভীর ভাবে অনুশীলন করতে হবে, দেখতে হবে কখন কীভাবে এটা পতনের দিকে এগিয়ে গেল। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে সাধারণ মানুষের স্বার্থে কথা বলার পরেও কেন লোকজন আমাদের ভোট দেয় না। আমাদের মানুষের সাইকোলজি স্টাডি করতে হবে। যেখানে ধর্মীয় নেতারা স্বর্গ নরকের কথা বলে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছে সেখানে আমরা কেন জীবদ্দশায় সুন্দর জীবনের কথা বলে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারছি না? আমরা কেন মানুষের মনের ভেতর ঢুকতে পারছি না? যদি মানুষ ভালো মন্দের চেয়ে পাপ পুণ্যের বয়ান বেশি পছন্দ করে তাদের বলতে হবে অন্যকে সাহায্য করা, অন্যের পাশে দাঁড়ানো পুণ্য আর অন্যকে ঠকানো, ঘুষ, দুর্নীতি এসব পাপ। অর্থাৎ আমাদের বয়ানে পরিবর্তন আনতে হবে, সেটা মানুষের বোধগম্য করতে হবে। আমাদের আসল কাজ তো মানুষকে অভাব মুক্ত করা, জাতীয় সম্পদে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা। কে ধর্মে বিশ্বাস করল আর কে করল না এটা তো মূল কথা নয়। বর্তমানে অনেকেই পশ্চিমা বিশ্বে তাদের জৌলুষ দেখে মনে করে যে সমাজতন্ত্র ফেল করেছে। সমাজতন্ত্রের লড়াই এখন নিজের খেয়ে বনে মোষ তাড়ানো। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বের মানবিক চরিত্রের পেছনে রয়েছে সমাজতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতা এবং সে সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম না হয় এজন্য শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতি করা। আজ পশ্চিমা বিশ্বে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের জীবনে যে দুর্দশা দেখা দিয়েছে এটা সম্ভব হতো না সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব টিকে থাকলে। কারণ তখন নিজেদের দেশে যাতে সমাজতন্ত্রের জন্য আন্দোলন গড়ে না ওঠে সেজন্যে নিজেদের জনগণের স্বার্থের কথাও ভাবতে হত। তাছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে যে অক্টোবর বিপ্লবের আগে সমাজতন্ত্রের ধারণা আছে ধারণাটা ছিল ইউটোপিয়া বা কাল্পনিক, কিন্তু অক্টোবর বিপ্লব তথা সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, তা সে যত অপূর্ণই হোক না কেন, প্রমাণ করেছে যে চাইলে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বাস্তবায়ন করা যায়, এরকম একটা সমাজ তৈরি করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যর্থতার অনেক কারণ আছে তার একটা কারণ হলো যোগ্য লোকের অভাব। মেশিন যতবেশি সফিস্টিকেটেড হয় সেটা চালানোর জন্য ততবেশি যোগ্য শ্রমিক দরকার। সমাজতন্ত্রের চাকা ঘুরানোর জন্যও যোগ্য নেতৃত্বের দরকার, দরকার নতুন ধরণের মানুষ। তাই একদিকে যেমন হতাশ হবার কিছু নেই, অন্যদিকে নিজদের স্বপ্নকে সফল করতে হলে শুধু বিপ্লবী গড়লেই চলবে না, দরকার নতুন ধরণের মানুষ গড়া, দরকার নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করা। তবে মৌলবাদের হাত শক্তিশালী করে এরকম কিছু করে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না। তাই পার্টিকে এখন থেকেই ভাবতে হবে – তারা কি চায় – ক্ষমতার হালুয়া রুটি নাকি মানুষের মুক্তি? প্রধান উপদেষ্টার ক্ষুদ্র ঋণ নাকি দেশের সব মানুষের মধ্যে জাতীয় সম্পদের ন্যায্য বন্টন?

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো