মতামত

জীবনের চ্যালেঞ্জ: কর্মজীবনে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা

ফজলুল কবির মিন্টু

আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে আমি ছোট, মাঝারি এবং বড় পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তবে যে পদেই কাজ করি না কেন, মহান সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় আমি আমার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি সব সময়। আমি নির্দিধায় বলতে পারি, চাকুরীস্থলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আস্থা অর্জন ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ এবং প্রেরণা। অনেক সময় ছোট পদে থেকেও বড় পদের কাজ করতে হয়েছে আমাকে। তবে, আমার চাকরি জীবনে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং মুহূর্ত ছিল যখন আমি চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত সুপার ফাইন স্পিনার্স এন্ড নিটার্স নামক একটি স্যুয়েটার কারখানার মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।

এই প্রতিষ্ঠানে আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে। আমার দায়িত্ব ছিল শ্রমিকদের বেতন প্রদানের জন্য একটি পেরোল সফটওয়্যার তৈরি করা এবং সেই সফটওয়্যার ব্যবহার করে শ্রমিকদের মাসিক পেরোলশীট তৈরি করা। তখন আমি ভিজুয়্যাল বেসিক, এসকিউএল সার্ভার এবং ক্রিস্টাল রিপোর্ট এর সমন্বয়ে সফটওয়্যার তৈরি করতাম। সুপার ফাইন স্পিনার্স এন্ড নিটার্স ছিল সিঙ্গাপুরমালিকানাধীন একটি স্যুয়েটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যা অন্যান্য গার্মেন্টস কারখানার তুলনায় বেশ জটিল ছিল। কারণ স্যুয়েটার উৎপাদন প্রক্রিয়া বেশ কাঠিন্যপূর্ণ এবং শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা ছিল অনেক বেশি জটিল। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের এবং শ্রমিকদের মধ্যে প্রায়ই দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতো। কারখানায় যখনই নতুন কোন স্টাইলের কাজ শুরু হতো, তখন মালিক পক্ষ বলতো বাংলাদেশে বেশী মজুরি দেয়া হয়, তবে শ্রমিকেরা বলতো যে তাদের পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি অনেক কম। এই অবস্থায় একাধিকবার শ্রমিকদের মাঝে অস্থিরতা দেখা দিত। একবার যখন এই অস্থিরতা তীব্র আকার ধারণ করেছিল, তখন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।

এই সংকটময় মুহূর্তে আমাদের মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক, হরিলাল বাবু, প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন শ্রমিকদের বোঝানোর জন্য, কিন্তু কিছুতেই পরিস্থিতি শান্ত করা যাচ্ছিল না। আমি তখন কারখানার একপাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম। আমার মনে হলো, হরিলাল বাবু যেভাবে শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তাতে কিছু একটা ঘাটতি রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে অনেক জনসভায় বক্তব্য দেয়ার অভিজ্ঞতা ছিল আমার। আমি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও আমি সংশয়িত ছিলাম যে, শ্রমিকেরা আমার কথা গ্রহণ করবে কিনা। তবে কিছুক্ষণ পরেই অবাক হয়ে দেখলাম, আমার বক্তব্য তারা গ্রহণ করেছে। শ্রমিকেরা একটু শান্ত হলো এবং তাদের কয়েকজন আমার কাছে এসে বলল, আমি যদি দায়িত্ব নিই, তাহলে তারা কাজ শুরু করবে।

আমাদের প্রতিষ্ঠানের জিএম পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিছু সময় পর তিনি আমাকে এবং হরিলাল বাবুকে তার রুমে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং হরিলাল বাবুর সামনে আমাকে মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করলেন। আমি তখন বললাম, “আমি শুধুমাত্র কম্পিউটার প্রোগ্রামিং জানি, মানব সম্পদ পরিচালনার বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই।” তবে তিনি দৃঢ়ভাবে আমাকে বললেন, “আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। তুমি দায়িত্ব নাও।”

এভাবেই আমি মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে আমার যাত্রা শুরু করলাম। কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই একটি প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল। কিন্তু আমি কখনোই হাল ছাড়িনি এবং প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি।

২০১৪ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কিছু কমপ্লায়েন্স ইস্যুর কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমি ঐ প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি। আমার মানব সম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা ছিল আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ।

আমার এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, যে কোন পেশায় সফলতা অর্জনের জন্য শুধু পেশাগত দক্ষতা নয়, মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন, নেতৃত্বের গুণাবলী এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে কঠিন মুহূর্ত আসে, কিন্তু সে মুহূর্তগুলো থেকেই আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পাওয়া সম্ভব।

লেখকঃ সমন্বয়ক, জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্র, বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্প