বিজ্ঞান ভাবনা (১৮৪): ভালো মন্দ -বিজন সাহা
আমি সব সময়ই মিউজিক শুনতে পছন্দ করি। সেটা দেশি হোক, বিদেশি হোক, ক্ল্যাসিক্যাল হোক, আধুনিক হোক বা অন্য কিছু। প্রায় সব ধরণের মিউজিক শরীরে এক ধরণের তরঙ্গের জন্ম দেয়। আশির দশকে বিভিন্ন ধরণের মিউজিকল আসে বাজারে। এদের একটি ছিল জেসাস ক্রাইস্ট সুপার স্টার। ওখানে যিশু বলেন ঈশ্বরকে ঈশ্বরের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিও, সিজারকে সিজারের। আমি এটাকে অন্য ভাবে দেখি। সব মানুষের মধ্যেই ভাল আর মন্দ দুই ধরণের গুন আর দোষ থাকে। মানুষের দোষের সমালোচনা করার পাশাপাশি গুনের প্রশংসা না করলে সেই সমালোচনা হয় পক্ষপাতদুষ্ট। ছোট বেলায় পড়েছি কাজই মানুষের পরিচয়, কাজের মধ্য দিয়েই মানুষ সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। অথচ এখন মানুষের সামাজিক অবস্থান বা কোন মানুষের সাথে অন্যদের সম্পর্ক নির্ধারণ করে সে যা করছে তা ভালো না মন্দ। এটা অনেকটা জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র হবার মত। কর্মফল তোমার ভাগ্য নির্ধারণ করছে না, তোমার ভগ্য নির্ধারণ করছে সেই লোকজন যারা আগে থেকেই তোমার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট – তা সে পজিটিভ হোক আর নেগেটিভ হোক। এটাই আমাদের সমাজকে, আমাদের রাজনীতিকে কলুষিত করছে বছরের পর বছর।
বিভিন্ন সময় ফেসবুকেই টিউলিপ সিদ্দিকীকে নিয়ে বিভিন্ন লেখা দেখেছি। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি হলে এ নিয়ে আনন্দ উল্লাস দেখেছি, আবার এখন তিনি দুর্নীতির সন্দেহে পদত্যাগ করলে এ নিয়ে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। আচ্ছা টিউলিপ সিদ্দিকী বাংলাদেশের কে? তিনি কি কোন ভাবে বাংলাদেশের কাছে দায়বদ্ধ? তিনি ব্রিটিশ নাগরিক, তার ভালোমন্দ সেই দেশের সাথে জড়িত। তার হিসাব নিকাশ, তার দেনা পাওনা সব তো বৃটিশ জনগণ আর ব্রিটেনের আইন আদালতের সাথে। এতে আমাদের সুখের বা দুঃখের কী আছে? যতদূর জানা যায় তিনি বিচার যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য পদত্যাগ করেছেন। আমাদের কয়জন মন্ত্রী, কয়জন মানুষের সেই সৎ সাহস আছে? কয়জন দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়ে আদালতের সামনে দাঁড়াতে পারবেন? আমরা উল্টা ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজেদের কর মুক্ত করি। তাকে নিয়ে এই যে বিভিন্ন কথাবার্তা সবাই বলছি, যদি বৃটিশ আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন তখন আমরা কি তাকে নিয়ে ট্রল করার জন্য এতটুকু অনুতপ্ত হব? আমাদের আরও মনে রাখা দরকার পশ্চিমা বিশ্বের প্রচুর নেতা, এমনকি প্রথম সারির নেতারা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত হয়েও নিজ নিজ দেশের আইন না ভাঙার কারণে খালাস পেয়ে যান। আর আমাদের কোন দেশ কখনোই এদের বিচার করতে পারে না। টিউলিপ চৌধুরী যদি দোষী প্রমাণিত হন, এতে আমরা বড়জোর একটু খুশি হয়তো হতে পারি, কিন্তু এতে কি আমাদের আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান এতটুকু বাড়বে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশীদের স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে নেগেটিভ বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করতে পারে আমাদের এই অতি উৎসাহ। অন্যের বিপদে আনন্দিত হওয়া মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ।
আমরা প্রায়ই বলি ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে, অথচ নিজেরাই অনবরত ইতিহাস বিকৃত করে যাচ্ছি। বিগত পনের বছরে দেশে অনেক খারাপের সাথে ভালো অনেক কিছুই ঘটেছে। আজ যারা সেই সময়ের সমালোচনায় ব্যস্ত এক সময় তারাই বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে গেলে আনন্দে দুই হাতে বুক বাজিয়েছে। এসব তো আর শুধু বিগত সরকারের প্রোপ্যাগান্ডা নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে এসব সূচক প্রদান করেছে। অমর্ত্য সেন থেকে শুরু করে অনেক বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এসবের প্রশংসা করেছেন। আজ তাহলে আমরা শুধু ব্যর্থতার বয়ান নিয়ে এত ব্যস্ত কেন? আমি জানি কেন। কারণ বিগত সময়ের সবকিছুই যদি ব্যর্থতার আলোকে দেখানো যায় তবে বাংলাদেশের জন্ম, তার ইতিহাস, তার সংবিধান – সব কিছুকে মুছে ফেলতে সুবিধা হয়, সুবিধা হয় দেশকে, দেশের ইতিহাসকে ভিন্ন খাঁতে বওয়ানো। আর সেই প্রচেষ্টা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। একদল মানুষ কখনই বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। তারা একাত্তরের আগেও যেমন একাত্তরের পরেও তেমনি পাকিস্তানী রয়ে গেছে। বিগত দিনগুলোয় একের পর এক একাত্তরের স্মৃতি ধ্বংস করা, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের চেষ্টা সেটাই প্রমাণ করে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বাদ দেবার প্রস্তাব পেশ করেছে সংবিধান সংশোধন কমিটি। এমনকি দেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে। আর এসব আসছে বিগত ৫৩ বছরের শাসনকে সর্বতোভাবে অসম্মান করে। ভালো লাগুক আর নাই লাগুক, বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক ভুল ত্রুটির পরেও অনেক দেশের চেয়েই নিজেকে অনেক বেশি যোগ্য প্রমাণ করতে পেরেছে। প্রায় একই সময়ে স্বাধীন হওয়া অনেক দেশই অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়েছে। সত্তর দশকের তলাবিহীন ঝুড়ি আর নেই বাংলাদেশ। এখন নিজেরাই ভাবি, যদি সব কিছু এতই খারাপ হত দেশ এখানে আসল কীভাবে? তাহলে তারও তো পাকিস্তানের মতই ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবার কথা ছিল। মনে রাখবেন একটা দেশের জীবনে সংবিধান ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ যেমন ধার্মিকদের জীবনে নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ। ধার্মিকরা যেমন অটোম্যাটিক্যালি ধর্মীয় অনুশাসন পালন করে (এমনকি ফর্মাল হলেও), দেশ, প্রশাসন তেমনি সংবিধান পালন করে। সংবিধান না মানার জন্য সরকার ও প্রশাসনকে কাঠগড়ায় দাড় করানো যায়।
অনেকেই ভাবতে পারেন এর মধ্য দিয়ে হয়তো স্বৈরাচারকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। একদম না। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা বলে অতীতকে অস্বীকার করে খুব বেশি দূরে যাওয়া যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সমস্ত প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত উত্তরাধিকার অস্বীকার করতে চেয়েছিল সবাই দিনের শেষে কী অর্থনৈতিক, কী সামাজিক – সব ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ইউক্রেনের কথা না হয় বাদই দিলাম, জর্জিয়া, বাল্টিকের দেশগুলো সবাই হয় অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক ভাবে অবনতির দিকে গিয়েছে। এমনকি বাল্টিকের দেশগুলো থেকে লোকজন চলে যাচ্ছে পশিম ইউরোপে। রাশিয়াও এই অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে নব্বুইয়ের দশকে। কিন্তু যখনই তারা বুঝতে পেরেছে যে ভালো হোক আর মন্দ হোক সোভিয়েত আমল ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না, তখন তারা সেই সময়ের খারাপ দিকগুলোর যেমন সমালোচনা করেছে, একই ভাবে যাকিছু ভালো ছিল সেসব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। আজ পঞ্চাশটির বেশি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও যে তারা শুধু টিকেই নেই, নিজেদের ক্রমাগত শক্তিশালী করছে তার মূলে রয়েছে এই উপলব্ধি। একই কথা বলা যায় কাজাখস্তান সহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলো সম্পর্কে। আর্মেনিয়া পশ্চিমা বিশ্বের চাপে পড়ে সোভিয়েত উত্তরাধিকার অস্বীকার করার পথ ধরে নিজের বিপদ ডেকে আনবে বলেই অনেকের ধারণা। আমার মনে হয় একই ঘটনা ঘটেছে আমাদের সাথে। আজ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে উন্নতি করলেও অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ অবিভক্ত ভারতীয় উত্তরাধিকার অস্বীকার করা। চাই বা না চাই, আমাদের সবার গোঁড়া সেই ব্রিটিশ ভারতেই, এমনকি তার অনেক আগে থেকেই। জাতি হিসেবে আমরা গড়ে উঠেছি বৃহত্তর ভারতের অংশ হিসেবেই। তখন রাষ্ট্র ছিল না, কিন্তু ছিল এক বিশাল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিনিময় যা আফগানিস্তান থেকে বার্মা, এমনকি এর পূব দিকের অনেক অঞ্চলকেও এক অদৃশ্য সুতায় বেঁধে রেখেছিল। একে অস্বীকার করা মানে নিজেকে ছিন্নমূল করা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রের নামে ফ্রন্ট তৈরি করে, যেমন ইউক্রেন ফ্রন্ট, বেলারুশ ফ্রন্ট ইত্যাদি। এসব ফ্রন্টে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত এলাকার, সমস্ত জাতির লোকজন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এখন পশ্চিমা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান অস্বীকার করতে গিয়ে ইউক্রেনকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের সব ক্রেডিট দিচ্ছে। ওয়ারশ মুক্তির ক্রেডিট নিচ্ছে আমেরিকা যা মুক্ত করতে চার্চিলের ডাকে সাড়া দিয়ে স্তালিন পরিকল্পনার আগেই সেনা পাঠায় ও যেখানে ৬ লাখ সোভিয়েত সেনা বীরের মৃত্যু বরণ করে। একদিন তারা লাইকা, গ্যাগারিন, তেরেশকোভার নাম মুছে দেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে। যদি ভুলের সমালোচনার পাশাপাশি বিগত সব সরকারের সাফল্যের ক্রেডিট না দেই তবে একদিন বাহান্ন, একাত্তর এসবও হারিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতা থেকে। মনে রাখবেন জীবনে ভালো দিন, খারাপ দিন সব আসে, খারাপ দিনকে বাদ দিয়ে শুধু ভালো দিন দিয়ে জীবন কাহিনী লিখতে গেলে শুধু সত্যকেই অস্বীকার করা হয় না, জীবনকেই অস্বীকার করা হায়। মানুষের মত দেশ, দেশের ইতিহাস পূর্ণতা পায় ভালো মন্দ সবকিছুর মিলনে। তাছাড়া আগে যাকিছু ভালো তাকে লুকিয়ে রাখলে পরবর্তী প্রজন্ম যেমন হীনমন্যতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে পারে, তেমনি যা কিছু খারাপ সেটা লুকিয়ে রাখলে তারা আসন্ন বিভিন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান নাও হতে পারে। দুটোই সমানভাবে বিপদজনক। যারা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল বলে মনে করেন তারা এই সামান্য সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পারবেন বলে আশা রাখি।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো