বিজ্ঞান ভাবনা (১৮৫): যুদ্ধ ও শান্তি -বিজন সাহা
রাশিয়ায় পুরানো নতুন বছর নামে এক ধারণা চালু আছে। এটা আসলে কোন ধারণা নয়, এটা জুলিয়াস ক্যালেন্ডার। এক সময় রাশিয়া সহ পুরা খ্রিষ্টান বিশ্ব এই পঞ্জিকা অনুযায়ী চলত। পরে পশ্চিমা বিশ্ব গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা গ্রহণ করে, রাশিয়া জুলিয়ান পঞ্জিকায় থেকে যায়। যদিও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে রাশিয়া গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অফিসিয়াল কাজকর্ম করে, এদের অর্থোডক্স চার্চ চলে জুলিয়াস ক্যালেন্ডার অনুসারে। বর্তমানে এই ক্যালেন্ডার ১৩ দিন পিছিয়ে আছে। ফলে সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছর শুরু হয় ১৩ জানুয়ারি। সরকারি ভাবে এটা ছুটির দিন নয়, তবে রুশ পরিবারগুলো, ধর্ম মানুক আর না মানুক, এই উপলক্ষ্যে একটু ভিন্ন রকমের খাবারের ব্যবস্থা করে। আর এ কারণেই গত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউজে ফিরে এলেন তখন এখানকার অনেক কমেন্টাটর তাঁকে পুরানো নববর্ষের আদলে পুরাতন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত করলেন।
২০১৬ সালে ট্রাম্প যখন হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে নিখিল বিশ্বের মসনদে আরোহণ করেন তখন আমেরিকার উজির নাজির মহল থেকে শুরু করে সারা দেশে হুলস্থূল পড়ে যায়। শুরু হয় দোষী খোঁজা। রাশিয়া বড় দেশ, বিশাল ঘাড় তার। তার উপরে চাপানো হয় দোষ। বছরের পর বছর চলে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের কাজ। ফলাফল শূন্য। তাই এবারও রাশিয়াকে নিয়ে যে খেলা হবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। তবে এবারকার খেলা ভিন্ন ধরণের। ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে কি থামবে না সেটাই এখন ট্রিলিয়ন ডলার কোশ্চেন।
ট্রাম্প অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই ঘোষণা দিয়েছিলেন ক্ষমতা গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার। এখন বুঝেছেন – যুদ্ধ যেমন হুট করে শুরু হয় না, তেমনি হুট করে বন্ধ করাও যায় না। বিশেষ করে যুদ্ধ যদি হয় একান্ন বনাম একটি দেশের মধ্যে, যদি তাতে জড়িত থাকে তথাকথিত সভ্য জগতের মান সম্মান আর রাশিয়ার ভালুকের অস্তিত্ব। আজ যে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে যুদ্ধ বিরতির জন্য চাপ আসছে সেটা আসছে রুশ ভালুকের থাবার নীচে পড়ে। অনেকটা “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে” টাইপের। যদিও পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বলেছে তারা যুদ্ধ বিরতি চাইবে বা, পুতিন বাধ্য হবে যুদ্ধ বিরতি চাইতে। রাশিয়া কি চাইবে? এটাই দেখার বিষয়। না, রাশিয়া যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায় – যুদ্ধ বিরতি নয় চায় স্থায়ী শান্তি। আর এ প্রশ্নেই দ্বিমত দেখা দিতে পারে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বের লক্ষ্য রাশিয়াকে টুকরো টুকরো করা, রাশিয়াকে বশ্যতা মানানো। এর আগেও মিনস্ক চুক্তি হয়েছে, যুদ্ধ বিরতি হয়েছে। আর সেটাকে তারা ব্যবহার করেছে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। আজ পশ্চিমা বিশ্ব যখন কোণঠাসা রাশিয়ার কি এই যুদ্ধবিরতির দরকার আছে? যুদ্ধবিরতিকে রুশ ভাষায় বলে পিরিমিরিয়ে, শান্তির রুশ মির – তারা বার বার বলেছে আমাদের পিরিমিরিয়ে দরকার নেই, আমাদের দরকার মির। যুদ্ধ রাষ্ট্র শুরু করলেও এখন সারা দেশ, সব নাগরিক এর সাথে সম্পৃক্ত। এরা এখন এমন শান্তি চায় না যা তাদের দুই বা দশ বছর পরে আবার যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে ইউক্রেন কুরস্ক আক্রমণ করার পরে। তাই সব মিলিয়ে যুদ্ধ শেষ করা যুদ্ধ শুরুর চেয়েও অনেক বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে যদি না তাতে করে ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়।
ট্রাম্প সম্পর্কে এদেশে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। শাখনাজার সহ কেউ কেউ মনে করেন ট্রাম্প আমেরিকার গরবাচেভ। তিনিও আমেরিকার শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন চান। তবে গরবাচেভের মত তারও রয়েছে আমলাদের বিশাল বাহিনী। সোভিয়েত ইউনিয়নে এটা ছিল পার্টি আমলা, আমেরিকায় রাষ্ট্রীয়। যেকোনো পরিবর্তনই আমলারা সন্দেহের চোখে দেখে, নিজেদের চেয়ারটা বিপদের সম্মুখীন মনে করে। সোভিয়েত ইতিহাস আমরা জানি, তবে আমেরিকা সে পথে যাবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ট্রাম্প গরবাচেভের মত নাইভ নন। গরবাচেভের মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা নিজের জন্য পশ্চিমা রাজ দরবারে একটি হলেও আসনের ব্যবস্থা করা। ট্রাম্প বা আমেরিকার সেটা দরকার নেই। তিনি চান আমেরিকার অবস্থান আরও দৃঢ় করতে। অর্থাৎ দুজনেই পরিবর্তন চাইলেও দুজনের লক্ষ্য ভিন্ন। অন্য দিকে দুগিন ট্রাম্পকে নিজেদের লোক মনে করেন যিনি রাশিয়ার পক্ষে সরাসরি কিছু না করলেও ফ্যামিলি সহ বিভন্ন ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশনাল দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক, বিশেষ করে লিঙ্গের ব্যাপারে। এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প না চাইলেও রাশিয়ার পক্ষে কাজ করবেন বলে দুগিনের বিশ্বাস। তবে রুশ সরকারি কর্মকর্তারা বলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কে হল সেটা কোন বিষয় নয়, তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি রাশিয়ার বিরোধিতা করা, রাশিয়াকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা। একদল চায় গুলি করে হত্যা করতে, আরেক দল আলিঙ্গনের নাগপাশে শ্বাস রোধ করে মারতে। মৃত্যু দুই দলেরই একান্ত চাওয়া। এ কথা মাথায় রেখেই রাশিয়াকে নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করতে হবে। আর এই স্বার্থের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা। সেটা কোন মতেই মুখের কথা নয়, কাগজে কলমে লেখা নিরাপত্তার গ্যারান্টি। তবে এরা এটাও জানে যে কোন লিখিত গ্যারান্টিও গ্যারান্টি নয়, আমেরিকা খেয়াল খুশি মত যেকোনো লিখিত চুক্তি থেকে যেকোনো সময়েই বেরিয়ে যেতে পারে। তারপরেও। অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়া এখন চেষ্টা করবে পশ্চিমা বিশ্বের ফাঁদে নতুন করে পা না দিতে। আপাতত শুধু কথা হচ্ছে দুই প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতের। তবে এসব হচ্ছে গণ মাধ্যমে। ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে বা ইন্টার্ভিউয়ে, পুতিন তাঁর প্রেস সেক্রেটারির মাধ্যমে। এসবই মনস্তাত্ত্বিক খেলা। আসল খেলা শুরু হতে এখনও বেশ দেরী।
ট্রাম্প ইতিমধ্যেই বাইডেনের অনেক প্রকল্প স্থগিত করেছেন। ক্যানাডা, গ্রিনল্যান্ড, পানামা খাল এসবের উপর আমেরিকার দাবির কথা বলেছেন। বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। একদিকে অনুপ্রবেশকারীরা যেমন আমেরিকার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে অন্য দিকে কোন কোন ভাষ্য মতে তারা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্যও দায়ী। এখানে পরিবর্তন আনা দরকার কিন্তু এতো মানুষের জীবন ও জীবিকা এর সাথে জড়িত যে এই সমস্যার সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান আছে বলে মনে হয় না। কলোম্বিয়া প্রথমে প্রতিবাদ করলেও পরে বেআইনি ভাবে আমেরিকায় অবস্থানরত কলোম্বিয়ার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজী হয়েছে। এসব ছোট ছোট কিন্তু দ্রুত সাফল্য ট্রাম্পকে ভুল সিগন্যাল দিতে পারে। তিনি একই ভাবে রাশিয়া ও চীনের উপর এমনকি ব্রিকসের উপর চাপ সৃষ্টি করে সফল হতে চাইতে পারেন। সেটা হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু গাড়ি একবার থেমে গেলে যেমন বারবার থামার সম্ভাবনা থাকে সাফল্যের ক্ষেত্রেও তাই। একবার বাধা পেলে এসব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। ট্রাম্প কি রাশিয়া বা চীনকে খোঁচানোর আগে এসব ভেবে দেখবেন?
অন্যদিকে পুতিনের জন্য ইউক্রেন শুধু রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রশ্ন নয়, তাঁর নিজের সাফল্যের প্রশ্নও। তিনি কিন্তু প্রথম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন চেচেন যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। সেই যুদ্ধে রাশিয়া যখন কোণঠাসা, জেনারেল লেবেদ, বেরেজভস্কিদের লাভ লোকসানের হিসেবে পড়ে সেনাবাহিনী ও জনগণ যখন রাষ্ট্রের উপর বীতশ্রদ্ধ ঠিক তখনই পুতিন যুদ্ধের মোর ঘুরিয়ে দেন। এ জন্য একটা জিনিস দরকার ছিল – ব্যক্তি স্বার্থের উপরে ওঠা, দায়িত্ব নেয়া আর সেনাদের যুদ্ধ করতে দেয়া। অলিগারখি নয় মানুষের উপর আস্থা রাখা। এরপর রাশিয়া বিভিন্ন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে গেছে কিন্তু জনগণ সব কিছুর পরেও তাঁর উপর আস্থা রেখেছে, রাখছে। দীর্ঘ সময়ের বিলাসী জীবনের পরে যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নেমে আসে অনেকের ধারণা ছিল এই যুদ্ধ জন সমর্থন পাবে না। প্রথম দিকে তরুণ সমাজ, বিশেষ করে শহরে কর্মরত বিত্তশালী তরুণেরা দলে দলে দেশত্যাগ করলেও পরবর্তীতে তারচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সমস্ত রাশিয়ার সব জাতির ও ধর্মের সম্মিলিত প্রয়াসে বিজয়ের স্বাদ পেতে শুরু করেছে সবাই। এটা শুধু ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয় সমস্ত পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর তারচেয়েও বড় কথা অদূর ভবিষ্যতে ন্যাটো আর রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। তাই এসময় যেকোনো ধরণের ছাড় সাধারণ মানুষ পরাজয় বলে মনে করতে পারে। এটাকে তুলনা করা যায় যদি ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে তাজউদ্দীন পাকিস্তানের সাথে স্বায়ত্ব শাসনের চুক্তি করতেন। তাই পুতিনের হাতও এক অর্থে বাঁধা।
ইতিমধ্যে ট্রাম্প রাশিয়াকে আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছেন। রাশিয়ায় অবশ্য আর নিশেধাজ্ঞাকে মানুষ ভয় পায় না। এটা অনেকটা আমাদের দেশের হরতালের মত। অতি ব্যবহারে গুরুত্ব হারিয়েছে। বাল্টিকের দেশগুলো বাল্টিক সাগরকে ন্যাটোর আভ্যন্তরীণ সাগর বানাতে চাইছে। বাল্টিকে রাশিয়ার নৌবহর আছে। এসব ছোট দেশ অন্যের বলে নিজেদের বলীয়ান মনে করে বড় ধরণের যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা এরা বুঝতেই চায় না আমেরিকা জলের বালতি নিয়ে আসতে আসতে তাদের বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে। এরপর যদি আমেরিকা জিতেও যায় সেই বিজয় নৃত্যে অংশগ্রহণ করার দুর্ভাগ্য বাল্টিকের দেশ, পোল্যান্ড বা পূর্ব ইউরোপের কোন দেশেরই হবে না। ভালুকের দিকে লেলিয়ে দেয়া শিকারি কুকুরদের অনেকেই ভালুকের থাবার আঘাতে প্রাণ হারায় আর এ নিয়ে শিকারি কখনও দুঃখ প্রকাশ করে বলে জানা যায় না। তারপরেও শিকারি কুকুর ভালুক দেখলেই তার পিছু নেয়। এসব জেনেও কিছু কিছু দেশ, কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা নিজের দেশ ও দেশের মানুষদের অনিবার্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এখন বকরুপী যক্ষ সবচেয়ে আশ্চর্য কি এ প্রশ্ন করলে যুধিষ্ঠির হয়তো উপরের উত্তরটাই দিতেন।
সব সমস্যারই বিভিন্ন সমাধান থাকে, কিন্তু সব সমাধান হয় গ্রহণযোগ্য হয় না অথবা হলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এর মূল কারণ প্রতিটি সমস্যার কিছু বিশেষত্ব থাকে। তাই দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য সেই বিশেষত্বগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়। এটা অনেকটা কম্পিউটারের ক্যাবলের মত, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ক্যাবল নির্দিষ্ট ছকেটে লাগে। জোর করে অন্য ক্যাবল ঢোকাতে গেলে কম্পিউটার নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে। একে বলে ফুল প্রুফ। আশা করি বিশ্ব নেতারা এটা বুঝবেন এবং স্থানীয় জনগণের মতামত, এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সমস্যার সমাধান খুঁজবেন। তা না করে কোন সাময়িক সমধান খুঁজতে গেলে ইউক্রেন সমস্যা আরেকটা ইসরাইল-প্যালেস্টাইন বা দুই কোরিয়া বা ভারত-পাকিস্তান সমস্যায় পরিণত হবে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো