মেহদী হাসান খান ও মোস্তাফা জব্বার
অভ্র কি-বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা মেহদী হাসান খান ও বিজয়ের সত্ত্বাধিকারী মোস্তাফা জব্বার

আগে ম্যাসেঞ্জার আর হট মেইলে ইংরেজি দিয়ে বাংলায় চ্যাটিং করতাম। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে চাকরিতে এসে যখন বাংলায় লিখতে হয়, তখন আমার জন্য অভ্র ফোনেটিকে লেখা সহজ ছিল। কারণ আমি তো আগে ইংরেজিতে লিখতে অভ্যস্ত ছিলাম, আর ইউনি বিজয় শেখার সময় আমার ছিল না।” এভাবেই অভ্র কি-বোর্ডে লেখা শুরুর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাদিয়া অরিন।

অভ্র ফোনেটিকে লেখার কারণে অফিসে শুরুতে অনেকেই তাকে নিয়ে মজা করতেন। এমনকি অনেকে তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন বলেও জানান মিজ অরিন।

তিনি বলেন, “এটার জন্য অনেকে আমাকে তুচ্ছ- তাচ্ছিল্য করতো। অ্যাজ ইফ ফোনেটিকে লেখা মানে আমি বাংলা ভাষা পারি না। অথচ তখন আমার ইউনি বিজয়ে শেখার সময়ই ছিল না। অথচ ফোনেটিকে দ্রুত রপ্ত করা যায়।” মিজ অরিনের মতে অভ্র কি-বোর্ডে কাজ করা সহজ এবং সময় কম লাগে। একইসাথে ডেস্কটপ কম্পিউটারের পাশাপাশি মোবাইলেও এই কি-বোর্ডে অভ্যস্ত তিনি।

শুধু কয়েকটি যুক্ত অক্ষরের ক্ষেত্রে বানান ভেঙে যায়, কিছুটা সমস্যা হয় বলে জানান মিজ অরিন।

এ বছর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসামরিক পদক একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে অভ্র কি-বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতা বা আবিষ্কারক মেহদী হাসান খানকে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করলে মেহদী হাসান একা এই পদক নিতে চান না বলে জানান।

পরে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান, মেহদী হাসান খানের আরও তিন সহকর্মী যারা অভ্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদেরসহ চার জনকেই দলগতভাবে দেয়া হবে এই সম্মাননা।

এই কি-বোর্ডের পথচলা শুরুর পর থেকে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে যাত্রা শুরু হয় এই কি-বোর্ডের?

আওয়ামী লীগের শাসনামলে কেনই বা মামলা, হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছিল অভ্র ফোনেটিকের দলকে?

অভ্র কি-বোর্ডের লোগো
অভ্র কি-বোর্ডের লোগো

যেভাবে যাত্রা শুরু করল অভ্র

অভ্র একটি ফ্রি সফটওয়ার। অর্থাৎ এটাকে বিনামূল্যে ইচ্ছেমত ব্যবহার ও বিতরণ করা যায়।

ব্যবহারকারীরা বলছেন, এই কি-বোর্ডে কাজ করা এতই সহজ যে বাচ্চারাও ঘণ্টাখানেক মোবাইলে চেষ্টা করলে এটা শিখতে পারে।

ফোনেটিক এই কি-বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মেহদী হাসান খান একজন চিকিৎসক ও প্রোগ্রামার।

যখন এই সফটওয়ারটি প্রতিষ্ঠা হয় তখন তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। বাকি সঙ্গীরাও ছাত্র ছিলেন।

বর্তমানে জার্মানিতে বসবাস করেন মি. খান। পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তিনি বাংলাদেশে আসবেন।

দলগতভাবে একুশে পদক প্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অভ্র কি-বোর্ডের পেজে অভ্রের যাত্রা কীভাবে শুরু হয়েছে সে বিষয়ে লিখেছেন মি. খান।

তিনি লিখেছেন, “২০০৩ সালে যখন অভ্রর কাজ শুরু করলাম, তখন অভ্র বা আমাকে কেউই চিনতো না। একটা ফোরাম বানালাম মানুষের টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্য। ইউনিকোডের ব্যবহার তখনো নতুন, হাজারটা সমস্যা।”

ধীরে ধীরে এই অনলাইন ফোরামে মানুষ সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করলে তা সমাধান করার চেষ্টা করেন বলে জানান মি. খান।

তিনি লিখেছেন, “অথবা ‘বাগ’ (সফটওয়্যার কোডিংয়ের একটা ত্রুটি) থাকলে ঠিক করে নতুন রিলিজ দেই। কিছু মানুষ, আমি যাদের চিনি না, তারাও আমাকে চিনে না, এরা শুধু সমস্যা নিয়ে আসার বদলে ধীরে ধীরে বাকিদের সমস্যা সমাধানে আমার সাথে যোগ দেয়া শুরু করলো। একসময় অনলাইন ফোরামের বাইরে এদের সাথে দেখা করলাম। সবাই ছাত্র তখন আমরা।”

মেহদী হাসান খান
অভ্র’র প্রতিষ্ঠাতা মেহদী হাসান খান বর্তমানে জার্মানিতে বসবাস করেন

সম্মিলিত এই কর্মযজ্ঞের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “কোনো কারণে অভ্রর মিশনটায় তারা বিশ্বাস করেছে, এর বাইরে আর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই তাদের। ফোরাম থেকে শুরু হয় বাংলা ফন্ট বানানো, সফটওয়্যার বানানো, সব কিছু একসাথে করলাম আমরা।”

তবে বিভিন্ন সময়ে ফোরামে অবদান রাখা অনেকে আবার নানা কারণে চলে গেলেও হাতে গোনা কয়েকজন থেকে যান বলে লেখেন তিনি।

“কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজন লেগে থাকলাম আমরা বছর দশকের উপর। স্বার্থহীন এমন মানুষজন একসাথে ছিল দেখে স্বার্থপর লোকজন চেষ্টা করেও আমাদের আটকাতে পারে নাই,” লিখেছেন মি. খান।

একুশে পদক প্রাপ্তির বিষয়ে ফেসবুক পোস্টে মি. খান আরও জানিয়েছেন, দলের কাজের কৃতিত্ব যাতে একক ব্যক্তি না পায়, সে বিষয়ে সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করেছেন।

পরে দলগতভাবে তার সহকর্মীদেরসহ এ পদক পাবেন বলে উল্লেখ করেছেন মি. খান।

অভ্রের এই প্রতিষ্ঠাতা মেহদী হাসান খান টিম-ওয়ার্কের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন ফেসবুক পোস্টে।

তিনি লিখেছেন, “পরের প্রজন্মের জন্য অভ্রর মিশনটা যদি রেখে যেতে হয়, সাথে আমাদের টিম-ওয়ার্কটাও উদাহরণ হিসেবে থাকুক। একা একা তো বেশিদূর যাওয়া যায় না।”

বাংলা ফন্ট ইউনি বিজয় ডট নেট ফ্রেমওয়ার্ক ও ভিজ্যুয়াল বেসিকের ওপর প্রথম লেখেন মেহদী হাসান খান।

পরে অভ্র কি-বোর্ড ব্যবহারকারীদের সুবিধায় ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ছাড়াই তা লেখেন।

অভ্র সম্পূর্ণভাবে ইউনিকোড উপযোগী। এই সফটওয়ারটি ২০০৩ সালের ১৪ই জুন ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম থেকে স্বীকৃতি পায়।

২০০৩ সালের ২৬শে মার্চ অভ্র কি-বোর্ড প্রথম উন্মুক্ত করা হয়।

পরে ওই বছরই সেপ্টেম্বরে নিজের সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ওমিক্রন ল্যাব থেকে অভ্র সফটওয়ার উন্মুক্ত করেন মি. খান।

অভ্রের প্রতিষ্ঠাতাদের আরেকজন তানবীন ইসলাম সিয়াম জানান, এই সফটওয়ার ডায়নামিক টাইপের হওয়াতে যা লেখা হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই অ্যান্সারটা হয়। এটাকে ফোনেটিক বলে।

বিবিসি বাংলাকে মি. সিয়াম বলেন, “মানুষের আসলে নতুন করে লে আউট শেখার প্রয়োজন হচ্ছে না। যে ইংরেজি বা রোমান হরফে লিখতে অভ্যস্ত ওই লে আউট ব্যবহার করে যদি বাংলা লেখা যায়, তবে নতুন লে আউটের প্রয়োজন হচ্ছে না। এ কারণে মানুষ দ্রুত এটা আয়ত্ত করে ফেলে।”

মোস্তাফা জব্বার
বিজয়ের সত্ত্বাধিকারী মোস্তাফা জব্বার কপিরাইট অফিসে অভ্র’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন

আওয়ামী লীগ আমলে হেনস্থা কেন?

বাংলাদেশে অভ্র প্রতিষ্ঠার আগে থেকে যে বাংলা সফটওয়ারটি কি-বোর্ডে ব্যবহার করা হতো সেটি হলো বিজয়।

তবে এটি একটি বাণিজ্যিক সফটওয়ার। মূলত এই সফটওয়ার ব্যবহার করতে হলে ব্যবহারকারীকে পয়সা গুনতে হয়।

এই সফটওয়ারের সত্ত্বাধিকারী হলেন আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে ২০১৮ সালে মন্ত্রীসভায় টেকনোক্রেট মন্ত্রী হিসেবে ছিলেন তিনি।

তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মি. জব্বার।

মোস্তাফা জব্বার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ১৯৮৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় কী বোর্ড ও সফটওয়ার প্রকাশিত হয়।

১৯৮৯ সালেই এই সফটওয়ারটির কপিরাইট করানো হয়েছিল বলে জানা যায়।

অন্যদিকে অভ্র ব্যবহারে গ্রাহককে কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না। কেননা সেটি একেবারেই উন্মুক্ত, বিনামূল্যের।

২০১০ সালে প্রথম অভ্র কি-বোর্ড বা সফটওয়ারটি রোষানলে পড়ে।

যখন মি. জব্বার ওই বছরের এপ্রিলে একটি সংবাদপত্রের এক নিবন্ধে অভ্রের দিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করেন, হ্যাকাররা তার ‘বিজয়’ সফটওয়্যারটি চুরি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অভ্র কি-বোর্ডকে পাইরেটেড সফটওয়্যার হিসেবে ওই লেখায় অভিহিত করেন তিনি।

মি. জব্বার সে সময় অভিযোগ করেছিলেন যে, জাতীয় তথ্য ভান্ডার তৈরির কাজে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে অভ্র কি-বোর্ড ব্যবহার করা হয়েছে।

সে সময় গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন ব্লগে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলে।

অনেকের লেখায় বলা হয়েছিল, নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পে বাণিজ্যিক বিজয় সফটওয়ারের পরিবর্তে বিনামূল্যের অভ্র ব্যবহার করার কারণে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে মি. জব্বার অভিযোগ করেছেন।

ক্রমাগত হুমকি, উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছিল এই বিনামূল্যের সফটওয়ার প্রতিষ্ঠানটিকে।

এক পর্যায়ে বিনামূল্যের অভ্র সফটওয়ারের বিরুদ্ধে কপিরাইট অফিসে আইন ভঙ্গের অভিযোগ করেন মি. জব্বার।

তার অভিযোগ ছিল, অভ্র সফটওয়ারের সাথে ইউনি বিজয় নামে যে কি-বোর্ডের লে-আউট সরবরাহ করা হয়, এটি প্যাটেন্টকৃত বিজয় কি-বোর্ড লে আউটের নকল।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে কপিরাইট অফিস মেহদী হাসান খানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়।

ওই নোটিশের পর মি. খান সময় আবেদন করলে ২০১০ সালের ২৩ মে পর্যন্ত তাকে সময় দেয়া হয়।

পরে ওই বছরের জুনে ঢাকার আগারগাঁও এ অবস্থিত বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অফিসে মেহদী হাসান খান ও মোস্তাফা জব্বারের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।

অভ্রের চার প্রতিষ্ঠাতার একজন তানবীন ইসলাম সিয়াম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এরপরে আমরা কি-বোর্ডের ওই লে-আউট রিমুভ করে দিয়েছিলাম। এখানে একটা লে আউট ছিল যাতে বিজয় কি-বোর্ডের লে আউটের কিছু কিছু অংশ মেলে। যারা বিজয় থেকে ইউনিকোডে টাইপ করতে পারছে না, তাদের জন্য এটা ছিল। কিন্তু দুটো এক ছিল না।”

মি. সিয়াম বলছেন, অভিযোগকারী পক্ষের সাথে সমঝোতার পর পরবর্তী ভার্সনে ওই লে আউট রাখা হয়নি।

তবে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজী হননি বিজয় সফটওয়ারের সত্ত্বাধিকারী মোস্তাফা জব্বার।

অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে
সব ধরনের স্মার্ট ফোনে বিজয় বাংলা কি-বোর্ড সংযুক্ত করতে ২০২৩ সালে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি

সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিজয় বাধ্যতামূলক

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানি করা সব ধরনের স্মার্ট ফোনে বিজয় বাংলা কি-বোর্ড সংযুক্ত করতে ২০২৩ সালে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

বিজয় কি-বোর্ডের মালিক এবং তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সে সময় বলেছিলেন, বিজয় বি-বোর্ড “বাংলা লেখার জাতীয় মান” হওয়ার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিটিআরসির স্পেকট্রাম বিভাগ সব ধরনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট বা এপিকে ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করে।

এ ধরনের নানা প্রতিকুলতা সামলাতে হয়েছে অভ্র কি-বোর্ড বা সফটওয়ারটিকে। এখন তারা পেয়েছে একুশে পদক।

# জান্নাতুল তানভী, বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা