হোটেল শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন: একটি বাস্তব চিত্র -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত এক অমানবিক ও কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে, রমজান মাস আসলেই এই শ্রমিকদের জন্য এক অন্ধকারময় অধ্যায় শুরু হয়। দেশের অধিকাংশ হোটেল ও রেস্টুরেন্টে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা এমনই যে, তাদের মানবাধিকার এবং শ্রমিক অধিকার প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। এখানে আমরা তাদের কয়েকটি প্রধান সমস্যার কথা তুলে ধরব, যেগুলো শ্রমিকদের জীবনযাপনকে কঠিন করে তোলে।
১. নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্রের অভাব
হোটেল শিল্পে কর্মরত শ্রমিকরা সাধারণত নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র বা সার্ভিস বুক পান না। এতে তাদের চাকুরির নিরাপত্তা এবং বৈধতা নিয়ে সন্দেহ থাকে। শ্রমিকরা জানেন না যে, তাদের কাজের আইনগত সুরক্ষা রয়েছে কিনা, যা তাদের ন্যূনতম সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র না থাকায়, শ্রমিকদের বেতন, ছুটি, এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিপত্তি সৃষ্টি হয়।
২. অস্বচ্ছ মজুরি এবং ছুটির অভাব
হোটেল শ্রমিকরা অধিকাংশ সময় তাদের কাজের জন্য উপযুক্ত মজুরি পান না। শ্রমিকদেরকে কোনো নিয়মিত সাপ্তাহিক ছুটি, উৎসব ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি বা পীড়া ছুটি দেয়া হয় না। এর ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন, কিন্তু মজুরি বা ছুটির অভাবে পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনা করতে তাদের কষ্ট হয়। এভাবে শ্রমিকরা বছরের পর বছর কাজ করলেও কোনও ধরনের ছুটি বা বিরতি তারা পায় না। এমন কি কোন শ্রমিকের বাবা-মা বা নিকটতম কোন আত্মীয় মারা গেলেও একজন বদলি শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে তারপর ছুটি নিতে পারে।
৩. রমজান মাসে চাকুরিচ্যুতি এবং মজুরি বঞ্চনা
রমজান মাসে, ব্যবসার পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে হোটেলগুলো দিনের বেলা বন্ধ রাখা হয়। ফলে, অধিকাংশ শ্রমিক পুরো মাসটি কর্মহীন হয়ে পড়েন। এই সময়টাতে শ্রমিকদের মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হয়। অধিকাংশ শ্রমিক উৎসব বোনাসপায় না। কিছু হোটেল, শ্রমিকদেরকে ঈদের সময় ১/২ হাজার টাকা বোনাস হিসেবে দেয়া হয়, তবে এই বোনাসও প্রায়ই অনিয়মিত এবং অপ্রতুল আবার অনেক মালিক শ্রমিকেরা ঈদ শেষে কাজে যোগদান করলেই বোনাস পায়। এমনকি রমজান মাস শেষে বেশিরভাগ শ্রমিকের চাকরি চলে যায় এবং নতুনভাবে নিয়োগ দেয়া হয় শুধুমাত্র মালিকপক্ষের পছন্দের শ্রমিকদের। অন্যরা স্থায়ীভাবে চাকুরিচ্যুত হয়ে যায়, অথচ তারা কোন ক্ষতিপূরণ বা সহায়তা পায় না।
৪. ঈদ উদযাপন এবং পরিবারের দায়িত্ব পালনে অসুবিধা
রমজান মাসে চাকুরিচ্যুতির কারণে, শ্রমিকদের জন্য পুরো রমজান মাস জীবনধারণ এবং ঈদ উৎসব উদযাপন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। পরিবার ও সন্তানদের জন্য উপহার কেনা, তাদের সঙ্গ নিয়ে আনন্দ করতে পারা এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে শ্রমিকরা খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক শ্রমিক অভিযোগ করেছেন, ঈদের দিন তারা লজ্জায় পরিবারের সদস্যদের কাছে মুখ দেখাতে পারে না।
৫. শ্রম আইন এবং মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন প্রয়োজন
এ সকল সমস্যা ও অবহেলার পেছনে মূলত শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার বাস্তবায়নের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের শ্রম আইনে প্রতিটি শ্রমিকের জন্য সুষ্ঠু কাজের পরিবেশ, মজুরি, ছুটি, এবং চাকুরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত, কিন্তু সেই আইনের বাস্তবায়ন আজও অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। সরকারের উচিত, এই শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ও তাদের ন্যায্য সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
উপসংহার
হোটেল শ্রমিকদের জীবন যাপন এক কঠিন সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে। তাদের শ্রমের সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, মজুরি, ছুটি, এবং চাকুরির সুরক্ষা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে যে, তারা এই সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিক। শ্রমিকদের জীবন মান উন্নয়ন এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব এবং তাদের প্রতি আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)