বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে শ্রমিকদের দুঃখদুর্দশা: একটি পর্যালোচনা -ফজলুল কবির মিন্টু

সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতটি দেশের স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম প্রধান খাত হলেও, এর শ্রমিকদের জীবনমান ও অবস্থা অত্যন্ত করুণ। এ খাতের শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা, ছুটি এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা সম্পর্কিত অধিকার থেকে বঞ্চিত। যার ফলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন এবং এর ফলে এই খাতের সেবার মানও প্রতিনিয়ত অবনতি হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে কাজ করা শ্রমিকরা নানা ধরনের মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে।
অপ্রতুল মজুরি
বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের অধিকাংশ শ্রমিকের মাসিক বেতন অত্যন্ত কম, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট নয়। সাধারণত, আয়া বা মাসীদের বেতন ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, ওয়ার্ড বয়দের বেতন ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা, এবং নার্স বা ব্রাদারদের বেতন ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকার মধ্যে থাকে। এসব শ্রমিকদের অনেক সময় ২ শিফট, কখনো ৩ শিফট পর্যন্ত কাজ করতে হয়, ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং অল্প মজুরির কারণে অনেক শ্রমিকের পক্ষে স্বাস্থ্য সেবার মান বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
এই সেক্টরে কোনো নির্দিষ্ট নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন না হওয়ায়, শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে, তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায়, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য একটি ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। উল্লেখ্য বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের একমাত্র সংগঠন ‘বেসরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কর্মচারী ইউনিয়ন’ দীর্ঘদিন যাবত এই সেক্টরে ন্যুনতম মজুরি বোর্ড গঠন করে শ্রমিকদের ন্যুনতম মাসিক মজুরি ২০ হাজার টাকা নির্ধারনের দাবি জানিয়ে আসছে কিন্তু রহস্যজনক কারনে অদ্যাবধি কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙছেনা।
ছুটির অভাব
বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ছুটির ব্যবস্থা প্রায় nonexistent। অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটি, পীড়া ছুটি, উৎসব ছুটি এবং নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন প্রদান করে না। এমনকি এই ধরণের ছুটি বিধান যে আছে সেটাও অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানে না। ফলস্বরূপ, শ্রমিকরা অতিরিক্ত কাজের চাপের মধ্যে পড়ে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পেয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। এছাড়া, অনেক শ্রমিকের ছুটির প্রয়োজন হলে, তাকে প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে অন্য এক শ্রমিককে ম্যানেজ করে ছুটিতে যেতে হয়, অনেক নারী শ্রমিক সন্তান সম্ভাবা হলে তাদের চাকুরিচ্যুত করা হয় -যা সমস্যার গভীরতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
নারী শ্রমিকদের প্রতি অবিচার এবং যৌন হয়রানি
বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হন। অনেক সময় তারা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করেন, যার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। শ্রমবিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৫ সদস্যবিশিষ্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক, তবে বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। নারীরা তাদের এই সমস্যা নিয়ে কথা বললে, অনেক সময় চাকরি হারানোর ঝুঁকির মুখে পড়েন।
এটি শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং এর ফলে কর্মক্ষেত্রে এক ধরনের নির্যাতন তৈরি হয়, যা শ্রমিকদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে। তাই, প্রতিটি বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও কার্যকর করা প্রয়োজন।
আউট সোর্সিং শ্রমিকদের অবস্থা
বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাখাতে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, আউট সোর্সিং শ্রমিকদের প্রায় কোনো অধিকার নেই। তাদের কাজের শর্তাবলি স্পষ্ট নয় এবং তাদের সুবিধা প্রায় শূন্য। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশ সময় নির্ধারিত মজুরি, ছুটি, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। আউট সোর্সিং শ্রমিকদের নিয়োগে শ্রম আইনের যে বিধান রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা হয় না। মূলত আউট সোর্সিং মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্যই হলো শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চিত করা।
মৌলিক সুবিধার অভাব
বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ক্যান্টিন/ডাইনিং সুবিধা, ডে কেয়ার সেন্টার, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এমনকি, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে মহিলা শ্রমিকদের জন্য আলাদা ড্রেস চেঞ্জ করার রুমও নেই। অথচ তারা দীর্ঘ সময় কাজ করে বিধায় এধরনের সুবিধা থাকা খুবই দরকার বলে জানিয়েছেন কর্মরত শ্রমিকেরা।
শ্রম আইনের ২৩৪ ধারা অনুসারে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ তহবিল এবং কল্যাণ তহবিল স্থাপনের বিধান থাকা সত্ত্বেও, প্রায় কোনো বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এই তহবিল গঠন হয়নি। এর ফলে, শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণের জন্য কোনো ধরনের অবকাঠামো বা সহায়তা নেই, যা তাদের জীবনের মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্টিনে কাজ করা কিছু শ্রমিক জানিয়েছে, তাদের মজুরি মাসিক ৪,০০০ থেকে ৪,৫০০ টাকা মাত্র। এতে তাদের খাবারের খরচও কভার হয় না বিধায় তারা কোন রকমে ক্যান্টিনেই রাত যাপন করতে বাধ্য হয়। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান থাকার ব্যবস্থা করলেও সেখানে থাকার কোন পরিবেশ থাকে না। একটা ছোট রুমে গাদাগাদি করে ৮/১০ জন থাকে। এমন পরিস্থিতি পুরোপুরি অমানবিক এবং শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
উপসংহার
বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে কর্মরত শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। তারা কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বা মৌলিক সুবিধা না পেয়ে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরি এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শ্রমিকদের এই অবস্থা পরিবর্তন করতে হলে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে একটি ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করা জরুরি, যাতে শ্রমিকরা সঠিক মজুরি ও সুবিধা পেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, ছুটির ব্যবস্থা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি এবং আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ প্রথা বাতিল করতে হবে।
এছাড়া, শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো মৌলিক সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। এভাবে, শ্রমিকদের জীবনের মান উন্নয়ন সম্ভব হবে এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে সেবা গ্রহণকারীরা উন্নত স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারবেন।