বিজ্ঞান ভাবনা (১৮৯): শিক্ষা -বিজন সাহা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। তাই শিক্ষা নিয়ে সব সময়ই বিভিন্ন তর্ক বিতর্ক হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ তরুণ সমাজকে আমরা যা শেখাব তারা সেভাবেই ভাববে। আর সেই ভাবনার উপর নির্ভর করবে জাতি কোন পথে বিকশিত হবে। বলতেই পারেন আজকাল তো এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শেখে। কিন্তু যেখান থেকেই শিখুক না কেন তাকে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী। সেই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করে চাকরির বাজার। তাই সঠিক শিক্ষাক্রম তরুণদের দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনিবার্য।
বিগত সরকারের শাসনামলে ভোটের কথা মাথায় রেখে যখন মাদ্রাসা শিক্ষাক্রমকে জাতীয় শিক্ষাক্রমের সমমর্যাদা দেয়া হয় তখনই মনে হয় দেশের চাকা ঘুরে যায়। আজ আমরা যা দেখছি তা অনেকাংশেই এই সব সিদ্ধান্তের ফল। আজ যদি আমরা বলি দেশ মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে তাহলে একথাও সত্য যে এটা হয়েছে শেখ হাসিনার হাত ধরেই। শিক্ষাক্রমের ইসলামীকরণ তার জন্যে ছিল সাময়িক সুবিধা লাভ (বাস্তবে সেটাই ঘটেছে) তবে সেটা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কুফল বয়ে এনেছে এবং আনবে বলেই মনে হয়। ব্যক্তিগত ভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই, সমস্যা সেটা কীভাবে হবে সেই প্রশ্নে। আর এটা বলতে গিয়েই রাশিয়ার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলব।
২০২১ সালে ভোলগা তীরের শহর ভ্রমণের সময় আমরা গিয়েছিলাম নিঝনি নভগোরাদ বা গোরকি শহরের পেচেরস্কি ভজনেসেনস্কি পুরুষদের মনাস্তিরে। এই মনাস্তিরটি ১৩২৮ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এর প্রতিষ্ঠাতা গ্র্যান্ড ডিউক ইউরি ভসেভোলোদোভিচ। এক সময় মনাস্তির, গির্জা এসব শুধু ধর্মীয় কাজেই ব্যবহৃত হত না, সেখানে বিয়ের সনদ, জন্ম মৃত্যুর সনদ এসবও জমা থাকত। সোভিয়েত আমলের আগে এরাই এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করত। তাছাড়া প্রতিটি মনাস্তিরে আছে স্থানীয় ইতিহাসের জাদুঘর। যেহেতু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এসব শহরের অতীত নিয়ে জানা, তাই এখানে আসা। এই মনাস্তির সম্পর্কে জানার আগ্রহ নিয়ে আমি মিউজিয়ামের গেটে বসা ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম।
– শুভ সকাল!
– শুভ সকাল!
– আমাদের কিছু জানার ছিল। যদি একটু বলেন।
– আপনারা বরং টিকেট কেটে জাদুঘরে ঢুকুন। সেখানে গাইড আছেন। তিনি অনেক তথ্য জানাতে পারবেন।
– না, আমাদের ঠিক অফিসিয়াল ইতিহাসের দরকার নেই। এর বাইরে কিছু জানতে চাইছি।
– ঠিক আছে। চেষ্টা করব।
– আপনি কি এখানেই কাজ করেন?
– হ্যাঁ।
– আপনি কি এখানেই থাকেন?
– না, এটা ছেলেদের মনাস্তির। আমি প্রতিদিন সকালে এসে কাজে জয়েন করি।
– তার মানে এটা অন্য দশটা কাজের মতই একটা। আপনি নিশ্চয়ই বেতন পান। কে দেয়?
– রুশ অর্থোডক্স চার্চ। ওরাই আমার কর্মদাতা।
– পেনশন কি ওরাই দেবে?
– যেকোনো কোম্পানির মত ওরাও পেনশন ফাণ্ডে টাকা পাঠায়। ওখান থেকেই পেনশন পাব। সে অর্থে আমরা সরকার থেকেই পেনশন পাই অন্য দশজনের মত।
– আর যদি কাজ ছেড়ে দিতে চান তাহলে?
– তাহলে আর কি! এখানে যে সময়টা কাজ করলাম সেটা আমার এক্সপেরিয়েন্স হিসেবে থাকবে আর পেনশনের সময় এটাও যোগ হবে।
– এখানে কারা থাকে?
– ছেলেরা, যারা ঈশ্বরের সেবা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছে।
– এরা কি একেবাবে শিশু কাল থেকেই এখানে থাকতে শুরু করে বা অল্প বয়স থেকে?
– না।
– তাহলে কোন বয়সে এখানে আসে?
– স্কুল শেষ করার পর এরা আসে। আসে প্রাপ্ত বয়স্ক (১৮ বছর) হলে যাতে নিজেদের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে।
– এরা কি এখানে কোন পেশা পায়?
– ঈশ্বরের সেবাই এদের পেশা। এখানে তাদের পাঁচ বছর পড়াশুনা করতে হয়।
– এ যে দেখছি ইউনিভার্সিটির পড়াশুনার মত। সেটা কি উচ্চ শিক্ষার সরকারি কমিটি দ্বারা স্বীকৃত?
– অবশ্যই।
– তার মানে এই ডিপ্লোমা নিয়ে এরা চাকরি করতে পারবে।
– হ্যাঁ, শুধু নিজের পেশায়।
এখানে উল্লেখ করা দরকার একজন ডাক্তার যেমন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে না, ডাক্তার হিসেবেই কাজ করে, থিওলজির উপর পড়াশুনা করে এরা শুধু এ লাইনেই কাজ করতে পারে।
– আর যদি কেউ এখান থেকে চলে যায়?
– সে চাইলে অন্যত্র কাজ করতে পারে। তখন এটা তার পেশা থাকবে না, তবে যেহেতু স্কুল শেষ করে এখানে আসে, নিজের একটা জায়গা সে ঠিকই খুঁজে নিতে পারে। বড় কথা হল ১৮ বছর বয়সে নিজের সিদ্ধান্তে যারা এখানে আসে তারা সাধারণত এখানেই থেকে যায়।
ঘুরে ফিরে দেখলাম সেমিনারিস্টরা শুধু এখানে পড়াশুনাই করে না, বাগান করা থেকে শুরু করে সমস্ত কাজকর্মই ওদের করতে হয়। এসব মনাস্তিরের অধীনে কিছু জমিজমাও থাকে, সেখানে ফসল ফলানো থেকে শুরু করে গৃহস্থালির নানান কাজ এরা নিজেরাই করে। এক কথায় এখানে ওদের বাস্তব জীবনের পুরো কোর্সটাই শেখানো হয়। এটাকে বলা চলে আবাসিক স্কুলে। নিজেদের সমস্ত কাজকর্ম এরা নিজেরাই করে। যারা এখানে থাকে তাদের বলা হয় সন্ন্যাসী বা মঙ্ক। তিন ধরণের সন্ন্যাসী বা মঙ্ক আছে। সাদা পাদ্রী নামে এক দল আছে যাদের বৌ ছেলেমেয়ে আছে। তবে তারা পাদ্রী হন বিয়ের পরে আর পাদ্রী হবার পর বিপত্নীক হলে বিয়ে করতে পারেন না। দ্বিতীয় দল বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা করেন। এছাড়া সেলিবাতি নামে এক ধরণের ফর্ম আছে যখন মানুষ সন্ন্যাসী হয় না আবার বিয়েও করে না। তবে এই ব্যবস্থা মানে এদের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা আমার বেশ মনে ধরল।
আমাদের ভ্রমণের আরেক পর্যায়ে আমরা এলাম কালমিকি। রাশিয়ায় মূলত চার ধর্মের লোকজন বসবাস করে। রুশ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ আর ইহুদি। এর বাইরের ছোটখাটো বিভিন্ন ধর্মের লোক আছে। তবে দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংস্থায় এই চার ধর্মের প্রতিনিধিদেরই দেখা যায়। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই কালমিকি এসে আমরা চাইলাম বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছ থেকে তাদের ইতিহাস শুনতে। এসব গল্প আমি জ্বলদর্চি পত্রিকায় ভোলগা নদীর খোঁজে নামক ধারাবাহিক রচনায় বিস্তারিত বলেছি। তাই ওল্ড টেম্পলে এক বৌদ্ধ লামা বা ভিক্ষুর সাথে কথোপকথন এখানে তুলে ধরব।
আমরা যখন ওল্ড টেম্পলে এসে পৌঁছুলাম সব দেখে মনে হল সেখানে লাঞ্চ বিরতি চলছে। স্তেপের মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে এই কমপ্লেক্স। পার্ক, বাগান। ফুল ফুটে আছে সেখানে। খুরুল বা মন্দির বেশ বড় হলেও শাক্যমুনির স্বর্ণ ভবনের মত এত জাকজমক পূর্ণ নয়। আমরা যখন এদিক সেদিক ঘুরছি তখন বছর তিরিশ বয়সের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এগিয়ে এল। ওই আমাদের প্যাগোডার ভেতরের দিকটা দেখাল আর বলল এখন সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে, আমরা যেন শব্দ না করি। বার বার অনুরধ করার পর ও ইন্টার্ভিউ দিতে রাজি হল, তবে অফ ক্যামেরা। এমনকি ওডিও রেকর্ড করাও বারণ।
– আপনি কি এখানে অনেক দিন থেকে?
– স্কুল শেষ করার পরে এখানে এসেছি।
– আচ্ছা! আগে আসতে পারতেন না?
– না! আঠারো বছর পূর্ণ না হলে আইন অনুযায়ী কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এর আগে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় বাবা মা। তাই প্রাপ্ত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
– কেন? বাবা-মা রাজি ছিলেন না?
– রাজি যে খুব একটা ছিলেন তা বলব না। কারণ তারা ভাবছিলেন আমি ভবিষ্যতে কি করে জীবন যাপন করব তা নিয়ে। তবে এখানে যোগ দেবার পরে মেনে নিয়েছেন। এখন প্রায় আসেন।
– এ জন্যেই কি আপনাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল?
– না, এজন্যে নয়। বাবা-মা রাজি থাকলেও এখানে আসার ব্যাপারে, মানে সন্ন্যাস গ্রহণের বিষয়ে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হত।
– ইন্টারেস্টিং। আমরা এক মনাস্তিরে গেছিলাম। সেখানেও সেমিনারিতে ভর্তি হতে হলে আঠারো বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
– হ্যাঁ, রাশিয়ায় সবার জন্যই এই ব্যবস্থা। আমি ভারতে ছিলাম বেশ কিছুদিন। সেখানে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা পর্যন্ত আশ্রমে থাকে।
– কোনটা ভালো?
– আমার মনে হয় আমাদেরটাই। যদি কোন কারণে আমার আশ্রম ছেঁড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাকে সাহায্য করবে। সমাজে মানিয়ে চলতে আমার জন্য আপেক্ষিক ভাবে বেশি সহজ হবে।
কয়েক দিন আগে কথা হচ্ছিল অনিকের সাথে। অনিক দিবালোক সিংহ মানে আমাদের টুটুল দার ছেলে। জন্ম মস্কোয়। ছোটবেলায় দেশে চলে যায়। ওখানেই কাজ করে। মস্কো এসেছিল মায়ের সাথে গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। দেশে উদয়ন স্কুলে পড়াশুনা করেছে। কথা হল দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে। ও নিজেই শুরু করল
– এমনকি আমাদের স্কুলেও আলাদা আলাদা ভাবে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে দেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকজন একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানে না। একই স্কুলে পড়াশুনা করেও বিভিন্ন ধর্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেয়াল তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে যারা মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া করে এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয় তাদের সাথে চিন্তার জগতের যে বিশাল ব্যবধান সেটা কল্পনা করা যায় না। আমি বলছি না যে সেখানে ভালো ছাত্র নেই। সেখানেও অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আছে। সুযোগের অভাবে তারা সরকারি স্কুলে পড়াশুনা করতে পারেনি। কিন্তু যখন সমাজ ও বিশ্ব সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে তখন আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই পরিবেশে বেড়ে উঠি। সেই যে দেয়াল সৃষ্টি হয় সেটা আর কখনোই দূর হয় না।
– হ্যাঁ। সেই দূরত্ব কমানোর জন্য দরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন শিক্ষানীতি। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও তা বাস্তবায়নের জন্য সাহস। রাশিয়ায় ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় না। ওদের পড়ানো হয় বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের ইতিহাস। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে কমবেশি ধারণা দেয়া হয়। আসলে স্কুল কী? স্কুল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জায়গা, যেখানে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ছেলেমেয়েরা একে অন্যকে জানে, পরস্পরের সাথে মত বিনিময় করে। শুধু পড়াশুনা করার জন্যই নয়, মানুষের সামাজিক হয়ে ওঠার জন্যও স্কুলের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ ইনক্লুসিভ, যে শিক্ষা বা বিষয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেটা এড়িয়ে যাওয়া দরকার। আমার মনে হয় দেশে যদি রাশিয়ার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কিছু করা হয় তাহলে সেটা দেশের বিভিন্ন ধর্মের লোকদের একে অন্যের সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে, পরস্পরের প্রতি যে ঘৃণা ও অবিশ্বাস সমাজে বিরাজমান তা কমবে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো