মতামত

কমরেড তাজুল: এক শ্রমিক নেতা যে পরাজিত হয়নি

-ফজলুল কবির মিন্টু

কমরেড তাজুল ইসলাম (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনে কমরেড তাজুলের অবদান আজও অনস্বীকার্য। তিনি ছিলেন একজন দৃঢ় প্রত্যয়ী নেতা, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার এবং তাদের জীবনে পরিবর্তন আনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র কমরেড তাজুল, যার জীবনে ছিল নানা সম্ভাবনা, কিন্তু তিনি এগুলোর দিকে না গিয়ে বেছে নিয়েছিলেন এক কঠিন পথ—শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ পাস করা তরুণের জীবনে অনেক সুযোগ থাকতে পারত, যেমন বিসিএস ক্যাডার হওয়া কিংবা কোনও কলেজে অধ্যাপনা করা। তবে তাজুল ভিন্ন পথ বেছে নেন। তিনি আদমজী শ্রমিক কলোনিতে গিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন, যা ততকালীন শাসকগোষ্ঠীর জন্য বিপজ্জনক মনে হয়। তাজুলের এই আন্দোলন তাদের জন্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ছিল, এবং তারা তাকে ধ্বংস করতে সমস্ত চেষ্টা চালায়। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ তাকে নির্মমভাবে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়, তবে তার অমর অবদান এখনও শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কমরেড তাজুলের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালেই ততকালীন স্বৈর শাসক এরশাদ শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। যার ফলশ্রুতিতে এখন শ্রমিকেরা বৎসরে দুইটি উৎসব বোনাস পাচ্ছে। মজুরি কমিশন এবং মজুরি বোর্ড গঠন  ঐ চুক্তিরই ফসল। বলা যায় রাষ্ট্রের সাথে শ্রমিকদের ১৯৮৪ সালের চুক্তি ছাড়া আর কোন চুক্তি সম্পাদিত হয় নি বরং ৯০ পরবর্তী শ্রমিক আন্দোলন ক্রমশঃ পথ হারিয়েছে।

আজ তাই বলতে হয়, কমরেড তাজুলের মৃত্যু ৪১ বছর পূর্ণ হলেও, ৯০ পরবর্তী বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন কোথাও সঠিক পথ খুঁজে পায়নি। বরং বর্তমান সময়ে শ্রমিক আন্দোলন আরো পিছিয়ে পড়েছে, এবং শ্রমিকরা  আজ চরমভাবে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রমিকরা এখনও শোষিত, বঞ্চিত, এবং বিভ্রান্ত। কষ্ট হয় যখন দেখি, অনেক নেতা আজকাল শ্রমিক আন্দোলনকে নিজেদের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছেন, ফলে তাজুলের কাঙ্ক্ষিত শ্রমিক মুক্তির আন্দোলন অনেকাংশে স্থবির হয়ে গেছে।

তাজুলের ৪১তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের স্মরণ করা উচিত যে, শ্রমিক আন্দোলনকে পুনরায় তার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চাই, তাহলে আমাদের তাজুলের আদর্শ এবং তার সংগ্রামের পথ অনুসরণ করতে হবে। তাজুলের মৃত্যুর পরের ৪১ বছরে আমরা যদি শ্রমিক আন্দোলনকে জাগিয়ে তুলতে পারি, তাহলে আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারব—যেখানে শ্রমিকরা তাদের অধিকার লাভ করবে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।

আজকে, তাজুলের মৃত্যুবার্ষিকীতে, আমাদের শপথ নিতে হবে—শ্রমিক আন্দোলনকে তার কাঙ্ক্ষিত পথে নিয়ে যেতে, এবং তাদের মুক্তির সংগ্রামে নতুন দিশা দেখাতে।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)