দলের আয়-ব্যয় নিয়ে কেন লুকোচুরি?

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো বিদেশ থেকে কোনো তহবিল নিতে পারে না। এনজিও থেকেও কোনো তহবিল নেয়ার বিধান নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, “কত অনুদান নেয়া যাবে তা বলা আছে। ব্যক্তির কাছ থেকে সর্বোচ্চ বছরে ১০ লাখ এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ বছরে ৫০ লাখ টাকা নেয়ার বিধান আছে।” দলগুলো ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ অনুদান গ্রহণ করতে পারে। এর বেশি হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান নিতে হয় চেকের মাধ্যমে।
তবে ফান্ডিং-এর এই বিধানটি খুব বেশি স্পষ্ট নয়। সংক্ষেপে বলা থাকলেও এ বিষয়ে বিস্তারিত নিয়ম আরপিওতে নেই। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে মূলত তাদের প্রতি বছরের আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। কোনো অভিযোগ পেলে কমিশন তা খতিয়ে দেখতে পারে। এর বাইরে এটা নিয়ে নির্বাচন কমিশন কিছু করে না বলে জানান মো. রফিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশে নির্বাচনে যারা প্রার্থী হন তাদের হলফনামার মাধ্যমে নিজেদের আয় ও সম্পদের হিসাব জমা দেন। আর নির্বাচনে খরচের হিসাবও জমা দিতে হয়। আর যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয় তাদেরও দলীয়ভাবে নির্বাচনের খরচ জমা দিতে হয়।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিবছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আগের পঞ্জিকা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ইসিতে জমা দিতে হয়।
২০২৪ সালে বিএনপি আগের বছর ২০২৩ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী ওই বছর বিএনপির আয় হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ ৮০ হাজার ১৫১ টাকা। আর ব্যয় হয়েছে তিন কোটি ৬৫ লাখ ২৩ হাজার ৯৭০ টাকা।
২০২২ সালে বিএনপির আয় হয়েছিল পাঁচ কোটি ৯২ লাখ ৪ হাজার ৬৩২ টাকা। আর ব্যয় হয়েছিল তিন কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮০৩ টাকা।
২০২৩ সালে আওয়ামী লীগের আয় হয় ২৭ কোটি ১৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এর আগের বছর ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের আয় হয় ১০ কোটি ৭১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৮ টাকা। ব্যয় হয় সাত কোটি ৮৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭৯ টাকা।
ওই বছরে জাতীয় পার্টির আয় হয়েছে তিন কোটি ২২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৩১ টাকা। এ সময় ব্যয় হয়েছে এক কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার ৫২৫ টাকা। ব্যাংকে জমা আছে দুই কোটি ৯ লাখ ৬১ হাজার ৩০৬ টাকা।
দলগুলো আয়ের উৎস হিসেবে প্রধানত সদস্যদের চাঁদা এবং শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানকেই আয়ের খাত হিসাবে দেখিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জমা দিতে হয়নি। বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এখন ৫৪টি। আগামী ২০ এপ্রিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শেষ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।
তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন এবং এর আগে পরে রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস এবং এর স্বচ্ছতা নিয়ে কথা হচ্ছে। বিশেষ করে এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন মনিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বিশাল সমাবেশের খরচ , ঢাকায় অফিস, হেলিকপ্টারে গণসংযোগ, পাঁচতারা হোটেলে এক হাজার ৩০০ মানুষের ইফতার পার্টি, ইত্যাদি নানা ব্যয়বহুল খরচে আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
এর জবাবে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অনেক স্বচ্ছল ব্যক্তি তাদের অনুদান দিয়েছেন, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বিবেচনায় নামগুলো প্রকাশ করছেন না। তবে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, “দলের নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে অবশ্যই আমরা আমাদের আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব দেবো।”
বাংলাদেশে নিবন্ধিত ৫৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১০টি নিবন্ধন পেয়েছে ২০২৩, ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০ এপ্রিল নতুন দল নিবন্ধনের শেষ সময় হলেও এনসিপি এই সময় বাড়িয়ে চাইবে বলে জানিয়েছেন এনসিপি নেতা মনিরা শারমিন।
এবার নতুন দল হিসাবে এই দলটিই আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে চাইলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে।
১. স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অন্তত একটি আসনে বিজয়।
২. সেসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন, সেসব আসনে মোট ভোটের পাঁচ শতাংশ অর্জন।
৩. কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে। দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় অফিস থাকতে হবে। অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার থানায় অফিস থাকতে হবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটার থাকবে।
এসব ছাড়াও নিবন্ধন পেতে আগ্রহী দলটির গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা, কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখাসহ (২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ) আরো কিছু বিধান রাখার শর্ত রয়েছে।
মনিরা শারমিন বলেন, “আমরা সব শর্ত পূরণ করেই নিবন্ধন নেবো। আর আমাদের আয়-ব্যয়ের উৎস এবং পরিমাণ ওয়েবসাইটেই নিয়মিত প্রকাশ করবো। আমরা মূলত ক্রাউড ফান্ডিং-এর ওপর জোর দিচ্ছি। দেশের অনেক মানুষ আমাদের সহায়তা করতে চায়। আমরা একটি কমিটি করেছি যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে যারা আমাদের অনুদান দিয়েছেন তাদের নাম প্রকাশ করিনি। কারণ সরকার পরিবর্তন হলে তারা যে বিপদে পড়বেন না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে!”
তবে জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে নিবন্ধনের এই সর্বশেষ তারিখ প্রযোজ্য হবে না বলে জানিয়েছেন দলটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তিনি বলেন, “নিবন্ধন ও প্রতীক নিয়ে আমাদের আপিল ঈদের পরে আপিল বিভাগে শুনানি হবে। আপিল বিভাগের আদেশ অনুযায়ী জামায়াতের প্রতীক এবং নিবন্ধনের বিষয়টি ফয়সালা হবে। ২২ এপ্রিলের পরে শুনানি হওয়ার কথা আছে।”
এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১৩ সালের আগস্টে জামায়াতের প্রতীক এবং নিবন্ধন বাতিল করে। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কশিমন এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত না হলে তারা দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, “আমরা রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়সহ নির্বাচনের খরচ এবং প্রার্থীর হলফনামায় স্বচ্ছতার প্রস্তাব করেছি। তারা যে হিসাব দেবেন তা তদন্ত করে কোনো গরমিল পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়ার বিধানও আমরা বলেছি। আর প্রার্থী যদি নির্বাচিত হন তাহলেও ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, “দলের আয়-ব্যয়ের ক্ষেত্রে আয়ের খাতগুলো প্রকাশ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনুদান দিলে তাদের নাম ঠিকানাও প্রকাশ করতে হবে। ইফতার পার্টিতে কোটি টাকার বেশি খরচ করে কোনো দল যদি বলে নিরাপত্তার কারণে দাতাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। এটা তো হয় না। তাহলে তো অনেকেই এখানো কালো টাকা দিয়ে ফেভার নিতে পারেন।”
তিনি মনে করেন, “এই যে রাজনৈতিক দলগুলোর আয়-ব্যয় নিয়ে এখন কথা হচ্ছে। এটা ভালো। মানুষ সচেতন হচ্ছে। মানুষও জানতে চায় কাদের অর্থে রাজনৈতিক দল চলে। আর এই যে জাতীয় নির্বাচনে একজন প্রার্থী সবোর্চ্চ ২৫ লাখ টাকা খরচ করতে পারবেন। নির্বাচনের পর তারা ব্যয়ের হিসাব দেন। কয়টি হিসাব সঠিক?”
টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাংলাদেশে বলতে গেলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সারাবছর দল পরিচালনায় যে অর্থ খরচ করে, তার আয়-ব্যয়ের প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করে না। ফলে এখানে কালো টাকার একটি অংশ আছে। আর হিসাব ঠিক মতো প্রকাশ না করলেই তো সেটা কালো টাকা। তারা যে অডিট ফার্মের একটা রিপোর্ট দেয় তা স্বচ্ছ নয়। সেটাও তদন্ত করে দেখা হয় না। এটা আসলে একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল যারা করছে তারাও এটা থেকে বের হতে পারছে না। তারা বলছে অনুদানকারীর নাম প্রকাশ হলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এটা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। আর গণতন্ত্রের জন্য এই স্বচ্ছতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, “প্রার্থীরা যে হলফনামা দেয়, আয় ব্যয়ের যে হিসাব দেয়, তাও প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে দলের এবং প্রর্থীর দুই জায়গায়ই আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা আনা দরকার।”
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, “যে দল যাদের জন্য কাজ করে তারা আসলে দলকে অর্থ দেয়। সেইভাবেই রজনৈতিক দলগুলো চলে। আমাদের দল সংগঠনের লোকজনের অনুদান, চাঁদা এবং সম্পদ থেকে অর্থ আয় করে। আমরাদের হিসাব পরিষ্কার। কোনো গোপনীয়তা নাই, থাকা উচিত নয়।”
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ডিডাব্লিউকে বলেন, “নতুন একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান, ফাইভস্টার পার্টিতে ইফতার পার্টিতে কোটি টাকা খরচ করবে আর আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করবে না, তাহলে তো মানুষ প্রশ্ন তুলবেই। সব রাজনৈতিক দলকেই হিসাব প্রকাশ করতে হবে।”
তিনি জানান, “আমরা দলের সদস্য, শুভাকাঙ্খী, দাতা, সম্পদ, প্রকাশনাসহ নানা খাত থেকে আয় করি। দলের কাজে সেটা ব্যয় করি। অডিট ফার্মের মাধ্যমে অডিট করিয়ে তা প্রতিবছর কমিশনে জমা দিই।”