বিজ্ঞান ভাবনা (১৯২): একটি জন্মদিন ও কিছু কথা– বিজন সাহা

১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে বিগত বছরগুলোর মত আড়ম্বর করে এই দিনটি পালন করা হয়নি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস এমনকি আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিভিন্ন ভ্রুকুটি সত্যেও বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট যথেষ্ট উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নিজের জন্মদিন পালন করতেন। এ নিয়ে দেশে বা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মনে ক্ষোভ ছিল। কিন্তু তারপরেও জন্মদিন পালনে বাধা ছিল না। এবার কি ছোট্ট পরিসরেও কেউ দেশে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালন করতে পেরেছে? এই না পারার জন্য কি শুধু আজকের ক্ষমতাসীনরাই দায়ী? আমি বিভিন্ন সময় সোভিয়েত জীবনের কথা লিখেছি। লিখেছি প্রতিটি কোণায় কোণায় লেনিনের স্ট্যাচুর কথা যা আমাকে ভারতের তীর্থস্থানগুলোয় শিব লিঙ্গের কথা মনে করিয়ে দিত। কিন্তু তীর্থের শিব আর কোণায় কোণায় লেনিনের স্ট্যাচুর মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য ছিল। শিবকে আপনি প্রণাম করতে পারেন আবার নাও পারেন, শিবের কথা আপনি শুনতে পারেন আবার নাও পারেন। এমনকি শিবের সমালোচনাও করতে পারেন (অন্তত তখন সেটা ছিল। বর্তমান ভারতে সেটা কতটুকু সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ)। কিন্তু সোভিয়েত আমলে প্রকাশ্যে লেনিনের সমালোচনা করা ছিল প্রায় অসম্ভব। এবং সেটা ছিল সর্বত্র। ইদানীং কালে রাশিয়ায় জাতীয় আইডিওলজি নিয়ে কথা উঠছে। আগে যে এধরনের আলোচনা হত না তা নয়। তবে ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধের কারণে অনেকেই মনে করে যে দেশের একটি জাতীয় আইডিয়া বা আইডিওলোজি থাকা একান্ত প্রয়োজন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এ দেশে রাষ্ট্রীয় অন্তত লিখিত আইডিওলজি নেই। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ সোভিয়েত আমলে রাষ্ট্রীয় আইডিওলোজি ডগমায় পরিণত করা হয়, এর ফলে সর্বত্র ভিন্ন মত দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। এটাও সমাজের বিপর্যয়ের একটি কারণ বলে অনেকে মনে করে। এখানে মনে রাখতে হবে যে ভিন্ন মত থাকে তাদেরই যারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত। এখানে আমি দ্বিমত করার জন্য দ্বিমত প্রকাশ করার কথা বলছি না, বলছি সেই সব মতের কথা যা সেই মত পোষণকারী মানুষ যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম, প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। তবে এখন যারা রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় আইডিওলজি থাকার পক্ষে মত দেন তারাও বলেন সেটা যেন কোন অবস্থাতেই সবার জন্য বাধ্যতমুলক করা না হয়। এটা যেন ডগমায় পরিণত না হয়। কারণ একবার সেটা হলেই রাষ্ট্র পারতপক্ষে ধর্মীয় বা থিওলজিক্যাল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আমি আওয়ামী শাসনামলে বন্ধুদের প্রায়ই বলতাম, শেখ মুজিব প্রশ্নে আওয়ামী সরকার যা করছে সেটা দেশকে মূলত ধর্ম রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিনের প্রায় একই অবস্থা হয়েছিল। এর ফলাফল আমরা জানি। বাংলাদেশেও ভিন্ন কিছু আশা করা যায় না। আমার ধারণা বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে যথেষ্ট সাফল্যের পরেও জনরোষের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের অন্যতম প্রধান কারণগুলোর একটি হল বঙ্গবন্ধু ও শেখ পরিবারকে নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। এ কথাগুলো শুধু আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করার জন্য বলা নয়, ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদেরও এই কথাটি মনে রাখা উচিৎ।
মৌলবাদ কি এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে, এমনকি মৌলবাদের আভিধানিক সংজ্ঞাও আছে। তবে আমি সব সময়ই মনে করি মৌলবাদ হল কোন কিছুতে অন্ধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস যেমন ভক্তি হতে পারে, তেমনি ঘৃণাও হতে পারে। নিজের বা নিজেদের এই অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে মানুষ যখন কোন কিছুর বিচার করে তখন সেই বিচার আর নিরপেক্ষ থাকে না। আর পক্ষপাতদুষ্ট বিচার খুব কম সময়ই ন্যায় বিচার হয়। মনে রাখতে হবে যে নষ্ট ঘড়িও দিনে দুইবার সঠিক সময় দেখায়। তাই অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কালেভদ্রে সঠিক ফলাফল পাওয়া গেলেও সেটা কাকতালীয়। তাই শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধভক্তি যেমন আওয়ামী লীগের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাঁর প্রতি অন্ধ ঘৃণাও অন্যদের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
আজ যারা শেখ মুজিবকে অন্ধও ভাবে ঘৃণা করে তাদের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে বলে মনে হয়। শুধু তাই নয়, এরা এক অর্থে পাকিস্তানের পক্ষেও। কিন্তু একটু খেয়াল করলে আর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মুসলিম লীগের বনেদী নেতারা নয়, শেখ মুজিবের মত মানুষেরাই পাকিস্তানের ভিত রচনা করেছিলেন। শেখ মুজিবের মত তরুণ নেতারাই পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিলেন। অন্যান্য নেতারা যখন কোলকাতা ও দিল্লিতে ইংরেজদের সাথে দর কষাকষিতে ব্যস্ত মুজিবের মত ছাত্র নেতারাই গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষের সমর্থন আদায় করেছেন। তাই আজকের পাকিস্তানপন্থীদের উল্টো মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা দরকার পাকিস্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রম করার জন্য। একই সাথে নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ কেন শেখ মুজিব যিনি পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য এত কিছু করলেন স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই বিরোধী পক্ষে চলে গেলেন। একই প্রশ্ন আওয়ামী লীগের করা উচিৎ, কেন চার খলিফা সহ ছাত্র নেতারা যারা বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য এত লড়াই সংগ্রাম করলেন, যারা মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বানালেন, তারাই স্বাধীনতার পরে নতুন দল গঠন করলেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে নামলেন। এ যেন সাতচল্লিশের পুনরাবৃত্তি। যে শেখ মুজিব তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মুসলিম লীগকে দোষারোপ করেন বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দেয়ার জন্য তিনিই কিন্তু দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের পথে চলতে শুরু করেন আর তা করতে গিয়ে নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সত্যিকার ইতিহাস চর্চা না করা, ইতিহাসকে বিকৃত করার এই সংস্কৃতি আমাদের বারবার একই ভুল পথে নিয়ে যায়।
ঠিক কী কারণে জানি না, তবে আমাদের নেতারা প্রায়ই প্রতীকী বিষয়গুলো হয় বুঝতে পারেন না নয়তো এড়িয়ে যান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় শুধু তাদের দলীয় বিজয় ছিল না, এটা ছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ। তারা চেয়েছিল পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে, আওয়ামী লীগ এখানে শুধুই ড্রাইভারের কাজ করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছে এটা একান্তই তাদের জয়। আর তাই স্বাধীনতার পরেও চেষ্টা করেছে এই জয়কে একান্ত নিজের করে নিতে, যদিও এ জয় ছিল বাংলার মুক্তিকামী মানুষের। ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিজয়কেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দল নিজদের মধ্যেই ভাগাভাগি করে নেয়। তারা ধরেই নেয় জনতার বিজয় আসলে তাদের সরকার গঠনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। একই ভাবে ২০১৩ সালে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে যখন গণ জাগরণ মঞ্চ তৈরি হয় তখন এটা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিই ছিল না, এর মধ্য দিয়ে মানুষ ন্যায় বিচারের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছিল। মানুষ বিশ্বাস করতে চেয়েছিল এমনকি যুগ যুগ পরে হলেও তারা ন্যায় বিচার পাবে। কিন্তু এখানেও আওয়ামী লীগ মানুষের এই দাবীর ভেতর শুধু নিজের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতি সমর্থন দেখতে পায়। ফলে বিজয়ের ফসলকে তারা ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে। ২০২৪ সালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচার ও রাজনীতিহীনতায় অতিষ্ঠ মানুষ আবার পথে নামে। কিন্তু সেই সংগ্রামের ফল আবার আরেক দল মানুষ নিজেদের ঘরে তুলে নেয়। রাষ্ট্রের বর্তমান হর্তাকর্তারা ভুলে যায় যে মানুষের ক্ষোভ বিশেষ কোন দলের প্রতি ছিল না, সমস্ত রকমের স্বৈরাচারকেই তারা না বলেছিল। মানুষ চেয়েছিল আইনের শাসন, চেয়েছিল হেলমেট বাহিনী মুক্ত বাংলাদেশ, চেয়েছিল সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু কী পেল তারা? আইন শৃঙ্খলার চূড়ান্ত অবনতি, মব সন্ত্রাস, নির্বাচনের অনিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও দেশের মানুষ একাত্তরের বিরুদ্ধে ছিল না। ৩২ নম্বরের ট্র্যাজেডি, সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধ্বংস, মন্দির, মাজার এসব ভাঙার জন্য মানুষ আন্দোলনে যোগ দেয়নি, মানুষ ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের মুক্ত করার জন্য রাস্তায় নামেনি। কিন্তু এ কোন বাংলাদেশ আজ আমরা পেলাম? কেন এমন হয় যে বার বার আন্দোলনে বিজয়ের পর আমরা অতীতের জন্য মন খারাপ করি? কারণ আমরা কখনোই মানুষের মুক্তি চাই না, শুধু অন্যদের সরিয়ে নিজেরা শোষকের আসনে বসতে চাই আর অতীতের শাসক শোষকদের দুর্বলতা দূর করার জন্য নিজেরা ভালো কিছু জনগণকে দেই না, উল্টা আরও কঠোর ভাবে শোষণ যন্ত্র চালাই। কারও রাজনীতি নিষিদ্ধ করে নয়, বরং সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড তৈরি করে আমরা দেশের রাজনীতিকে নতুন পথে নিতে পারতাম। শেখ মুজিব সব অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, যারা নিজ নিজ যোগ্যতা বলে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তাদের সঠিক মূল্যায়ন করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হবার নয়। আরব বিশ্বে এমনকি মুসলিম বিশ্বে নিজেদের অতীতকে অস্বীকার না করলেও বাংলা মুল্লুকে আমরা অতীত অস্বীকার করতেই অভ্যস্ত। ১২০১ সালে আগে আমাদের কোন ইতিহাস নেই, ১৯৪৭ এর আগে আমাদের কোন ইতিহাস নেই, ১৯৭১ এর আগে আমাদের কোন ইতিহাস নেই, এখন ২০১৪ এর আগে আমাদের কোন ইতিহাস নেই। অতীতকে অস্বীকার করা ধর্মীয় ডগমার মত আমাদের বুকে চেপে বসেছে। এ থেকে মুক্তি কোথায় কে জানে?
ফিরে আসি বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কথায়। এবার আগের মত ঘটা করে জন্মদিন পালিত না হলেও আমার মনে হয় এবারই শেখ মুজিব তাঁর জন্মদিনে মানুষের খাঁটি ভালবাসা পেয়েছেন। এবার আর কেউ ক্ষমতার লোভে বা নিজেদের কোন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাঁকে প্রশংসার বানে ভাসিয়ে দেয়নি। কোন নব্য মুস্তাক বিশাল ফুলের তোড়া তাঁর প্রতিকৃতিতে অর্পণ করেনি। তবে কী ফেসবুকে, কী মনে মনে যারাই এবার ১৭ মার্চ শেখ মুজিবকে তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছে – তারা সেটা অন্তর থেকেই করেছে, তাঁকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেই করেছে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো