শীর্ষ খবর:
মতামত

প্রসংগ চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি মনোনয়ন

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

গত ১২ মার্চ ২০২৫ চট্টগ্রামের দুইটি শ্রম আদালতের শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের নতুন গ্যাজেট প্রকাশিত হয়েছে, যা শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য একটি নতুন দিশা দেখানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই গ্যাজেটের মাধ্যমে ৬ জন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের, ৪ জন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন এবং ২ জন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র থেকে মনোনীত প্রতিনিধির নাম প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের জন্য একটি বড় দায়িত্ব এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার সময় এসেছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এই প্রথমবার চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের প্রতিনিধি মনোনীত হয়েছেন।

শ্রম আদালত শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে একটি অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচিত হয়। শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিরা এই প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যারা আদালতকে গতিশীল ও কার্যকর করতে দায়িত্ব পালন করে। তাদের কাজ হলো শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা, শ্রমিকদের জন্য কার্যকর প্রতিকার গ্রহণ করা এবং আদালতের মাধ্যমে শ্রমিকদের পক্ষে সম্মানজনক সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করা।

তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে তেমন সফল ছিলেন না। অনেক সময় দেখা গেছে, তারা শ্রমিকদের সঠিক অধিকার আদায়ের পথে যথেষ্ট সক্রিয়তা প্রদর্শন করেননি। এর ফলে, অনেক শ্রমিক নিজেদের দাবি আদায়ে ন্যায়বিচার পেতে দেরি এবং হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমনকি, শ্রমিকদের অধিকাংশ মামলা সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে সমাধান না হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন গ্যাজেটের মাধ্যমে মনোনীত প্রতিনিধিরা  তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কতটুকু সচেতন তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে তাদের জন্য এটি একটি বিশেষ সুযোগ, যাতে তারা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও তাদের স্বার্থের প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তাদের প্রধান কাজ হবে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অবস্থান নেয়া। যদি তারা শ্রমিকদের পক্ষে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সফল হতে পারেন, তাহলে  শ্রম আদালত এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রমিকদের মধ্যে আস্থা পুনঃস্থাপন করতে সহায়ক হবে।

তবে, গতানুগতিক কিছু সমস্যা রয়েছে। একদিকে, অতীতে যেমন স্বৈরাচারী আমলে শ্রম আদালতের প্রতিনিধির নিয়োগে দলীয়করণের চর্চা ছিল, তেমনি বর্তমানে তা পূর্বের তুলনায় আরো বেশী প্রতিফলিত হয়েছে। এই গ্যাজেটের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের ২ জন সদস্য ছাড়া বাকী ১০ জন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল এবং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন থেকে মনোনীত হয়েছেন। এটা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং জামায়াতে ইসলামী,  ৫ আগস্টের পর হতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যার প্রতিফলন আমরা দেখলাম চট্টগ্রাম আদালতের শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ যেই লাউ সেই কদু। বাস্তবতা খুব বেশী পরিবর্তন হয়নি।

পড়ুন:  আসন্ন বাজেটে জাহাজভাঙা শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের দাবিতে সমাবেশ

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের বয়সের বিষয়। এই মুহূর্তে যাদের মনোনীত করা হয়েছে, তাদের গড় বয়স সত্তরোর্দ্ধ, এবং এটি ভবিষ্যতে একটি দুর্বলতা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদি তরুণ বা মাঝারি বয়সের প্রতিনিধি সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তাহলে তাদের নতুন চিন্তাভাবনা ও উদ্যমের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে ৪ জন প্রবীণ এবং ৮ জন তরুণ প্রতিনিধির সমন্বয়ে দল গঠন করলে, তা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ফলাফল দিতে পারে। তাছাড়া বর্তমান সরকার একদিকে তারুণ্যের জায়গা করে দেয়ার কথা বলছে কার্যত তারা কাজ করছে সম্পূর্ণ বিপরীত-যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অতএব, নতুন গ্যাজেট শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সামনে একটি নতুন সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যদি তারা অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হন, তবে এটি শ্রমিকদের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা এবং তাদের ন্যায্য অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তাদের আস্থা পুনঃস্থাপন হয় এবং শ্রম আদালত আরও কার্যকর ও গতিশীল হয়।

নতুন প্রতিনিধিদের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা ও শুভকামনা রইলো। আশা করি তারা শ্রমিকদের পক্ষে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবেন এবং শ্রম আদালতকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করবেন।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)