বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১৯৩): স্বাধীনতা – এক ও অদ্বিতীয়  

-বিজন সাহা

 

 

২৬ মার্চ জাতি পালন করল স্বাধীনতা দিবস। আমার জন্য স্বাধীনতা দিবস মানে শুধু লোক আর লোক, বানের জলে ভেসে আসা মানুষ। খালি হাতে, এক কাপড়ে পালিয়ে আসা মানুষ। তরা ঘাটে ফেরী পার হয়ে আমাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছে দূরে আরও দূরে। পেছনে রেখে যাচ্ছে গতরাতের দুঃসহ স্মৃতি। সবার চোখে চোখে মুখে আতঙ্ক। সবাই যেন মৃত্যুর মুখ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে অজানা জীবনের উদ্দেশ্যে যদিও জানে না সামনে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে – জীবন না মৃত্যু। তবে তাদের আশু উদেশ্য আসন্ন মৃত্যু থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেঁচে থাকা, যে ভাবেই হোক জীবনকে আরেকটা সুযোগ দেয়া। গ্রামের লোকজন যে যেভাবে পারছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তাদের দিকে। আমরা ছোটরাও গ্লাস ভরে দুধ বা জল নিয়ে দিচ্ছি ঢাকা থেকে পলায়নপর লোকদের। বাবা নারায়ণগঞ্জ গেছেন ব্যবসায়িক কাজে। এ নিয়েও বাড়িতে চিন্তার শেষ নেই। এরপর শুরু হবে দীর্ঘ নয় মাসের এক অন্য জীবন। স্বজন হারানোর ভয় আর নতুন দেশে নতুন করে জীবন গড়ার আশা। নতুন দেশ পেয়েছে জাতি কিন্তু নতুন জীবন কি পেয়েছে? ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত কি নতুন জীবনের জন্য যথেষ্ট নয়? আজ সেই স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন করছে তারা যারা এই স্বাধীনতাকে মেনে নিতে বাধ্য হলেও কখনোই মনে নেয়নি।

আমি বিভিন্ন সময় বলেছি যে দেশভাগ ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। তার মানে এই নয় আমি যে আমি চাই আবার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এক হয়ে যাক। সেটা সম্ভব নয়, তার কোন দরকার নেই। প্রশ্ন আসতে পারে তিনটি দেশ যখন নিজের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে তখন ভুলের কী হল? যেকোনো কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে কি হয় নাই তার উপর। দেশভাগের মূল স্লোগান ছিল সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা ও ভারতবর্ষের মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো। আজ প্রায় আশি বছর পরে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা আগের চেয়ে বেশি, সাধারণ মানুষের অবস্থা আগের মতই তথৈবচ। সেই অর্থে দেশভাগ ব্যর্থ। তবে এসব দেশের এলিট শ্রেণী যদি এই সত্যটা গ্রহণ করে ও ভুল স্বীকার করে তবে সেটা এসব দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, আর সেটা হলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা আছে যার ফলাফল হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনে পজিটিভ পরিবর্তন আসার সুযোগ আসবে। কেননা বর্তমানে পরস্পরের বিরোধিতা করতে এসব দেশ যে অর্থ খরচ করে সেটা সামাজিক খাতে ব্যয় করা যাবে, তাছাড়া দেশের ভেতরে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা কমবে, কমবে পারস্পারিক সন্দেহ। মনে রাখতে হবে যেকোনো উন্নয়নের প্রধান শর্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে বঞ্চিত করে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, কারণ এতে করে দেশ এই সব মানুষের দেশপ্রেম ও সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়।

পৃথিবীর সব দেশের মত বাংলাদেশের মানুষও একটা উন্নত দেশ চায় যেখানে তারা নিরাপদে বসবাস করতে পারবে, যে দেশে নিজেদের ছেলেমেয়েরা শুধু লেখাপড়াই শিখবে না সেখানেই চাকরি বা ব্যবসা করে সৎ পথে আয় করে সম্মানের সাথে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারবে। আর এটা তখনই সম্ভব যখন সত্যিকার অর্থে আধুনিক রাষ্ট্র হবে, শুধু অর্থনৈতিক নয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি সব দিক থেকে উন্নত হবে। একটি রাষ্ট্র তখনই সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী ও মর্যাদা সম্পন্ন হয় যখন সে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করতে পারে। পৃথিবীর যেকোন উন্নত রাষ্ট্রের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। আর এমন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া অনেক বেশি সম্মানের। যারা রাষ্ট্রের চালক হতে চায় তাদের নিজেদেরই ঠিক করতে হবে তারা কি উন্নত দেশের জনগণের সেবক হতে চায় নাকি অনুন্নত দেশের সর্বেসর্বা হতে চায়। যদি তারা নিজেদের সভ্য দেশের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। আর সেটা অর্জন করার অন্যতম প্রধান শর্ত উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক বিশ্বাস জোরদার করা, যে জন্য দরকার ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পুনর্বিবেচনা। আর একমাত্র এভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব। তাহলে সব ধর্মের মানুষের নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হবে। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নয়, এটা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী শক্তির নাক গলানোর বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ। ধর্মনিরপেক্ষতা সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 

বিপ্লব, আন্দোলন এসবও বাজার অর্থনীতির নিয়ম মেনে চলে মানে ডিম্যান্ড ও সাপ্লাই-এর নিয়মে চলে। সমাজে ন্যায়বিচারের বা ন্যায্যতার ডিম্যান্ড সবসময়ই ছিল ও থাকবে। খুব কম ব্যবস্থা বা সরকার সেটা সাপ্লাই দেয়। আর তাই এই দাবিকে আন্দোলন বা বিপ্লবে পরিণত করার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। বিগত ৫৩ বছর ধরেই দেশে ন্যায়বিচারের দাবি ছিল। কিন্তু সেই দাবি কখনোই সফল আন্দোলনে পরিণত হয় নি। বা বলতে গেলে সেই দাবীর কাঁধে ভর করে বার বার রাজনৈতিক দল বা একদল মানুষ জনগণের সফল আন্দোলনের ফসল চুরি করে নিয়ে গেছে। এবারেও সেটার ব্যতিক্রম হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান রাশিয়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যুদ্ধ জিতেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু এদের কখনোই বলতে শুনিনি সেই যুদ্ধে জয় হয়েছে কোন রাজনৈতিক দলের। এরা সব সময়ই সেনাবাহিনী বা জনগণকে জয়ের মালা পরিয়ে দেয়। শুধু আমাদের দেশেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ, কিছু সেনা অফিসার বা কিছু সমন্বয়ক। একটা যুদ্ধ যখন হয় তখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সারা দেশই তাতে অংশগ্রহণ করে। আমাদের দেশেও ব্যতিক্রম ছিল না। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদের বাদ দিলে বাকি সবাই কোন না কোন ভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী শক্তি। এক কোটি মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলেও ছয় কোটি বাঙালি দেশে ছিল। সেই সময় যারা চাষাবাদ করে, দোকানপাট খোলা রেখে এদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে তাদের অবদানই বা কম কিসে? তাছাড়া যে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। সেদিক থেকে সমস্ত দেশটাই ছিল এই যুদ্ধের অংশ। সবাইকে যে মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিতে হবে তেমন কোন কথা নেই, তবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীও যে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি সেটা ঘোষণা করার সময় এসেছে।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৯২): একটি জন্মদিন ও কিছু কথা- বিজন সাহা

 

একজন সৎ ও বিবেচক অভিভাবক অন্যের সন্তানকে শাসন করার আগে নিজের সন্তানকে শাসন করেন, সঠিক শিক্ষা দিয়ে নিজের সন্তানকে সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। নিজের সন্তানের অন্যায়কে যে অভিভাবক প্রশ্রয় দেন তাকে আর যাই হোক সৎ ও বিবেচক বলা যায় না। সমাজ, ধর্ম, দেশ – এসব ক্ষেত্রেও কথাগুলো প্রযোজ্য। বিচারহীনতা এক বৈশ্বিক সমস্যা। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী অন্যায় করেও বিচার এড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের সব দেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু, অতীত ইউরোপে সাদা চামড়ার মানুষ, কিছু দিন আগেও আমেরিকায় সেক্সুয়াল মাইনোরিটি, বিএলএম। আসলে যখনই কোন গোষ্ঠী বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে তখন তাদের হাতে বাকীরা জিম্মি। হেলমেট বাহিনী, তৌহিদী জনতা এসবই এক বোতলের জ্বীন। এর জন্য দায়ী রাজনৈতিক দল। এখান থেকে বেড়িয়ে আসার উপায় কি? টোটালিটারিজম। সেখানে রাষ্ট্রের কাছে অত্যচার করার মনোপলি থাকে। তবে দিনের শেষে সেটাও ফলপ্রসূ হয় না। মানুষ যখন ক্রাউড হয় তখন তার বিবেক লোপ পায়, সে প্রায়ই জন্তুর মত আচরণ করে। তারপরও যারা এসব করে তাদের কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই একমাত্র এসব ঘটনা কমাতে পারে যদিও বন্ধ করবে না কোনদিন। দুঃখের বিষয় হল বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের মজ্জাগত। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে সত্যিকারের অপরাধীকে বিচারেও আওতায় না আনা আর একই কারণে নিরপরাধ মানুষদের উপর জেল জুলুম আমাদের দেশে এখন ডাল ভাতের মত হয়ে গেছে। সবাই এর বিরুদ্ধে বলে, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে সবাই এটাকেই ক্ষমতায় টিকে থাকার সফল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। সব দেখে মনে হয় আমাদের দেশে গণ অভ্যুত্থানও এখন পণ্য যা বিক্রি করে একদল মানুষ পাহাড় সমান সম্পদের মালিক হয়। সেই বিচারে আমার তো আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান সরকার – দুই দলকেই হাইজ্যাকার মনে হয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ হাইজ্যাক করেছিল সেটা বিক্রি করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধকে হাইজ্যাক করেছে তাকে প্রাণে মারার জন্য। ‌নিজের অস্তিত্বের জন্য আওয়ামী লীগের একাত্তরের চেতনা জিইয়ে রাখা যতটা অত্যাবশ্যক বর্তমান সরকার ও তাদের মদত দানকারী শক্তির অস্তিত্বের জন্য ঠিক ততটাই দরকার একাত্তরের চেতনা বাংলাদেশের বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলা। এখানে আপোষের সুযোগ তেমন নেই। সামোসা সম্পর্কে এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিখ্যাত উক্তি ছিল – সামোসা কুত্তার বাচ্চা এটা ঠিক, কিন্তু ও আমাদের কুত্তার বাচ্চা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয় স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তির বলার সময় এসেছে যে আওয়ামী স্বৈরাচারী দল, কিন্তু ওটা আমাদের স্বৈরাচারী দল। চাই বা না চাই বাংলাদেশে এখনও যারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পোষণ করে তাদের এক বড় অংশই আওয়ামী লীগের কর্মী বা সমর্থক। যদি একাত্তরের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করতে হয় তবে সেটা পতিত আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়েই করতে হবে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাক হানাদারদের আক্রমণ দলমত নির্বিশেষে প্রায় সমস্ত দেশকে এক করেছিল। ২০২৪ এর পরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের উপর যেভাবে হামলা চলছে তাতে বিএনপি, বাম দল, আওয়ামী লীগ সবাইকে একত্রিত হয়েই এই যুদ্ধ করতে হবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা দেশ পেয়েছি আর পেয়েছি কছি রাজনৈতিক দল ও কিছু ব্যক্তির নৈরাজ্য। এখান আমাদের দরকার প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা।

সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা। এক ও অদ্বিতীয় স্বাধীনতা!!! আর সেটা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা!!!!!!!

 

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো