বিজ্ঞান ভাবনা (১৯৫): ধর্ম ও সন্ত্রাস -বিজন সাহা
এক রোববার শুয়ে আছি সেভা এসে জিজ্ঞেস করল
– পাপা, ইসলাম সম্পর্কে তোমার ধারণা কী?
একটু অবাক হলাম প্রশ্ন শুনে। আমাদের বাসায় সাধারণত ধর্ম নিয়ে কখনও কোন কথাবার্তা হয় না। তবে বুঝলাম আবার হয়তো ইউটিউবে কোন ভিডিও দেখেছে তাই এই প্রশ্ন।
– হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– না, এমনিতেই একটা ভিডিওতে দেখলাম। তাছাড়া ওরা তো বিভিন্ন ধরণের সন্ত্রাসের সাথে জড়িত।
– সেটা ঠিক। তবে যদি তুই এ সন্ত্রাসের কারণ জানতে চাস তাহলে বলতে পারি। তার মানে এই নয় আমি সন্ত্রাসকে সমর্থন করি। কিন্তু যদি কেন এসব হচ্ছে তার কিছুটা বুঝতে চাস তাহলে আমাদের দেখতে হবে অনেক দূর থেকে। তাছাড়া ইসলাম শুধু সন্ত্রাসেই শেষ হয়ে যায় না, এটা এক সভ্যতা যার আছে ঐতিহ্যবাহী অতীত। এখন যারা সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তাদের বেশীর ভাগ ইসলামকে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে। এটা অবশ্য অনেকেই করে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র বা অন্যান্য ধর্মের নামেও প্রচুর অন্যায়, প্রচুর খুন খারাবি হয়।
আসলে ইসলাম বিশেষ করে ইসলাম ধর্মকে ঢাল বানিয়ে বর্তমানে অনেক কিছুই হচ্ছে যা আমি পছন্দ করি না। তবে এক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য ছিল সেভাকে এমনভাবে সব বুঝিয়ে বলা যাতে ও ধর্মের সাথে সন্ত্রাস গুলিয়ে না ফেলে। যেন বুঝতে পারে এটা এক দিনে হয়নি এর পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস।
– কিন্তু এখন তো প্রায় সব সন্ত্রাসী ঘটনাই ইসলামের সাথে যুক্ত!
– তা ঠিক, কিন্তু এক সময় এই ইসলামই ছিল সভ্যতার ধারক ও বাহক। যখন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার পতন ঘটে তখন আরবের বনিকেরাই ভারত ও চীনের জ্ঞান বিজ্ঞান ইউরোপে নিয়ে যায়। সেটা ইসলামের পূর্বে ও পরে দুই আমলেই ছিল। কিন্তু ইসলাম যখন আরব, পারস্য ও উত্তর আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে তখন এখানেই জন্মগ্রহণ করেন বিভিন্ন মনীষী। তবে একথাও সত্য জরদানো ব্রুনো, গ্যালিলিও সহ অনেক মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় মনীষী খ্রিস্টান ছিলেন, তারপরেও তাদের খ্রিষ্টীয় বিজ্ঞানী বলা কঠিন, কেননা এরা সবাই চার্চ দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন। আসলে বিজ্ঞানের পথ প্রশ্ন করার পথ, ধর্মের – বিশ্বাসের। তাই এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব আদর্শিক। তবে সব কিছুর মত বিজ্ঞানও সমাজেই পুষ্টি লাভ করে, সেদিক থেকে দেখলে অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্ম তাদের ভেতরে বিজ্ঞানের বিকাশের পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিল।
– তার মানে ধর্ম সমাজে পজিটিভ রোল প্লে করে, তাইতো?
– বলতে পারিস। আসলে ধর্ম বা অন্যান্য তন্ত্র সমাজের প্রয়োজনেই সৃষ্টি হয়েছে। এসব ধর্ম হয়েছে পরে, প্রথমে এদের উদ্ভব হয়েছে সমাজ সংস্কার হিসেবে। ইহুদী ধর্মের ইতিহাসে দেখব মিশরের ফারাওনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কিছু মানুষ যারা ফারাওনের শাসন মেনে নিতে চায়নি তারা মেসিয়ার ডাকে একত্রিত হয় ও মিশর ত্যাগ করে প্যালেস্টাইনে চলে যায়। তখন হয়তো তারা এটাকে সেই ভাবে ধর্ম ভাবেনি যা আমরা আজকে ভাবি। এটা ছিল প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা যা পরবর্তীতে ধর্মের রূপ নিয়েছে, কারণ তা ডগমায় পরিণত হয়েছে। আবার একই ভাবে ইহুদী ধর্মের মধ্য থেকে জন্ম নেয় খ্রিস্টান ধর্ম যখন যীশু ইহুদী ধর্মের সংস্কারের চেষ্টা করেন। ইহুদী ধর্মীয় নেতারা তাতে বাধা দিয়ে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে। পরবর্তীতে যীশুর শিক্ষাই ধর্মের রূপ নেয়। ইসলাম ব্যতিক্রম নয়। আরবের পৌত্তলিক ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ইসলাম। অন্য দিকে ভারতে আর্যরা নিয়ে আসে বৈদিক ধর্ম যা পরবর্তীতে স্থানীয় ধর্মের সাথে মিশে হিন্দু ধর্মের জন্ম দেয়। আবার এই হিন্দু ধর্মের সংস্কার করতে গিয়েই জন্ম নেয় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। সেই অর্থে প্রতিটি ধর্মের জন্ম সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের তাগিদ থেকে।
– সেসব তো অতীতের কথা। এখন?
– দেখ, বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য মূলত ইউরোপই দায়ী। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপ সারা বিশ্বকে পদানত করেছে, সারা বিশ্বের সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশের আদিবাসীদের ধ্বংস করে নিজেরা সেখানে নিজেদের মত করে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, মূলত তারা সম্পূর্ণ নতুন দেশ, নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছে এসব দেশে। এশিয়া ও আফ্রিকায় – যেখানে জনসংখ্যা বিশাল ও ট্রপিক্যাল এলাকা বলে জীবনধারণ যথেষ্ট কঠিন, সেখানে তারা বসবাসের চেষ্টা করেনি, সেখান থেকে মানুষ নিয়ে গেছে দাস হিসেবে আর সম্পদ নিয়েছে নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব মেটাতে। কিছু কিছু দেশে আধুনিক শিক্ষা ও শিল্প বিস্তারে ভূমিকা রাখলেও সেটা তাদের লুটপাটের তুলনায় কম। তাছাড়া এসব দেশের ছিল ঐতিহ্যময় ইতিহাস। ভারত, চীন, ইথিওপিয়া, মিশর এসব দেশে প্রাচীন সভ্যতা বিরাজমান ছিল। উপনিবেশিক শাসন একদিকে এসব দেশকে নিঃস্ব করেছে আর তারা যখন এসব দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় তখন এমন ভাবে দেশগুলো ভাগ করে যে প্রায় সমস্ত এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে থেকে যায় সীমান্তবিরোধ। ভারত পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, কুর্দিস্তান আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান সমস্যা আর্টিফিশিয়াল, মানুষের তৈরি। এমনকি আজও পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাবে উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে, নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন দেশ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এটাও ওদের তৈরি। আর এসবই জন্ম দিচ্ছে সন্ত্রাসের। আজ আমরা যে ইসলামী সন্ত্রাসের কথা বলি তার বেশির ভাগ তৈরি পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা। সমস্যা হল, হয়ত ধর্মীয় কারণেই অন্যদের তুলনায় মুসলমানদের খুব সহজেই সন্ত্রাসের পথে চালিত করা যাচ্ছে। এটা মূলত খুব বেশি রকম রক্ষণশীলতার কারণে। কোন মানুষ, কোন জাতি, কোন ধর্ম যদি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলাতে না পারে তবে তারা অতিরিক্ত রক্ষণশীল হতে বাধ্য। সেদিক থেকে দেখলে ইসলামী সন্ত্রাসের জন্য বাইরের শক্তির পাশাপাশি তারা নিজেরাও দায়ী।
– আচ্ছা সব যদি এত সহজ হয় তাহলে এরা বার বার ইউরোপিয়ানদের ফাঁদে পা দেয় কেন?
– প্রশ্ন তো এখানেই। এই দেখ ভারত বিভাগ। ভারত ভাগ হতেই পারত কিন্তু ঠিক যেভাবে তাকে ভাগ করা হয়েছে সেটা সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ উপায়। যদি জাতিগত ভাবে করা হত, যেমন বাংলা, পাঞ্জাব, মারাঠা, সিন্ধু ইত্যাদি, তাহলে এসব জাতি দীর্ঘদিন ধরে তারা যে সংস্কৃতি বা জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত সেভাবেই চলত। কিন্তু করা হল ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে দেখা গেল প্রচুর মানুষকে স্থানান্তরিত হতে হল শুধু ভিন্ন ধর্মের বলে যদিও অনেককেই যেতে হল ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন সংস্কৃতির এলাকায়। ফলে সে নিজের দেশেও পরদেশী হল। আর এটা করেছে কিন্তু ব্রিটিশরাই। ভারত ভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান ছিল না, ছিল সেই সমস্যা দীর্ঘদিনের জন্য জিইয়ে রাখা। একই ভাবে পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও দেশ ও জাতি ভাগ করা হয়েছে, কখনও ধর্মের ভিত্তিতে, কখনও অন্য কোন ক্রাইটেরিয়ায়। কিন্তু সবসময়ই সবচেয়ে অস্বাভাবিক পথ বেছে নেয়া হয়েছে। তারপরেও কেন যেন মানুষ তাদের বিশ্বাস করে, তাদের উস্কানিতে সাড়া দেয় আর পরিণামে নিজেদের দেশ ও জাতির জন্য এমন বিপদ ডেকে আনে যার পরিণাম অপূরণীয় ক্ষতি।
– কিন্তু ব্রিটিশরা সেটা পারল কিভাবে?
– এটাই তো কথা। আসলে মানুষ মাত্রই লোভী। সে চায় বেশি বেশি পেতে। তবে সে জানে ঘটনার স্বাভাবিক বিবর্তনে নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে সে অনেক কিছুই সহজে পাবে না। তখন সে বাঁকা পথে যাবার চেষ্টা করে। সে সময় যদি কেউ তাকে লোভ দেখায় তখন সে সেই পথ নেয়। সব সময় যে পরিণাম ভাল হয় তা নয়। যেমন ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন তাঁর প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। মীর জাফর ভেবেছিল সেই হবে সিরাজ পরবর্তী বাংলা বিহার উড়িষ্যার একচ্ছত্র অধিপতি। কিন্তু বাস্তবে সে হল ইংরেজদের হাতের পুতুল। এমনকি একজন কৃষকের যে স্বাধীনতা ছিল মীর জাফরের সেটাও ছিল না। ফলাফল? প্রায় দুই শ বছরের জন্য ভারতবর্ষ ইংরেজদের উপনিবেশ হল। যে ভারত সেই সময় পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ ছিল, পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫ ভাগ যে দেশে উৎপাদিত হত ইংরেজরা যখন ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে যায় – সে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি, তার উৎপাদন ৪% এর বেশি নয়। এই ইংরেজ যেমন মীর জাফরকে সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে ভারত দখল করেছিল, ঠিক তেমনি ভাবে তারা ভারতীয় মুসলমানদের আলাদা রাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশ ভাগ করেছিল। এতে করে ভারতবাসী বা ভারতীয় মুসলমানের কতটুকু লাভ হয়েছে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ খোদ ভারতে থেকে যাওয়া মুসলমান সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়েছে আর পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশে অন্য ধর্মের লোকেরা হয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। কিন্তু কোন দেশেই সাধারণ মানুষের জীবনেও তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি। বরং সমস্যা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র শেকড় গাঁড়তে পারেনি। অবিভক্ত ভারত আজ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হত বলেই অনেকের বিশ্বাস। আর তার ফলাফল সবাই ভোগ করত। কিন্তু প্রতিযোগিতা এড়িয়ে সোজা পথে সব কিছু লাভের লোভে ১৭৫৭ বা ১৯৪৭ এর মত এখনও মানুষ পশ্চিমাদের বিশ্বাস করছে আর পরিণামে পাচ্ছে অরাজকতা, ধ্বংসপ্রায় দেশ, কপাল পোড়া কোটি কোটি মানুষ।
– আর সন্ত্রাস।
– ঠিক। আর এই সন্ত্রাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নিজের দেশের মানুষ। এর সুযোগ নিচ্ছে তথাকথিত সভ্য বিশ্ব যারা মানবতা, বিশ্বশান্তি ইত্যাদির নামে আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে আর মজা দেখছে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো