বিজ্ঞান ভাবনা (১৯৬): ধর্ম ও সংস্কৃতি-বিজন সাহা
সেভার সাথে ধর্ম নিয়ে আমাদের কথা সন্ত্রাস ছাড়িয়ে অন্য দিকে মোড় নেয়। ও জিজ্ঞেস করে
– বুঝলাম ধর্ম ও সন্ত্রাস এক নয়। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে যদি সন্ত্রাসী কাজকর্ম করা হয় তাহলে রাষ্ট্রের কি উচিৎ নয় একে নিয়ন্ত্রণে রাখা বা নিষিদ্ধ করা?
– সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটা করেছিল। বিপ্লবের পরে ধর্মীয় কাজকর্ম প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল যে মানুষ প্রথমে রাষ্ট্রের ভয়ে ও পরে সামাজিক নিন্দার ভয়ে ধর্ম থেকে সরে যায়। কিন্তু যুদ্ধের সময় স্তালিন নিজেই চার্চের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই তুলে নেন। মানুষ তখন ঈশ্বরের নামে, স্তালিনের নামে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। এমনকি একাত্তর বছর অনাদরে অবহেলায় থাকার পরে নব্বইয়ের দশকে মানুষের ঢল নামে উপাসনালয়ে। যদিও খুব কম মানুষই ঐ অর্থে ধর্মে বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তারপরেও চাইলেই যে তারা উপাসনালয়ে যেতে পারে এটা মানুষকে সাহস যোগায়, ফলে এখন দেশের প্রতি মানুষের অনুভূতি অন্য রকম। এটা ধর্মের চেয়েও ধর্ম পালনের স্বাধীনতার কারণে। অন্তত আমার সোভিয়েত ও রাশিয়ার জীবনের অভিজ্ঞতা সেটাই বলে।
– আচ্ছা। কিন্তু বর্তমান সমাজে ধর্ম কি কোন পজিটিভ ভূমিকা রাখতে পারে?
– ধর্ম খারাপ না ভাল এই প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে। সমাজে ধর্মের ভূমিকা কী? ধর্মের নেতিবাচক ভূমিকার কথা মূলত বলে বামপন্থী রাজনীতিবিদরা। আমার কেন যেন মনে হয় “ধর্ম হল অপিউম” – কার্ল মার্ক্সের এই উক্তির উপর ভিত্তি করেই তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে, এ নিয়ে খুব একটা ভাবতে চায় না। ফলে যারা ধর্মে বিশ্বাস করে, ভালো মন্দ নির্বিশেষে এ ধরণের সবাইকে তারা নিজেদের শত্রুতে পরিণত করেছে। এটা বাম রাজনীতির অন্যতম বড় ব্যর্থতা। কারণ ধর্মে শুধু শোষকই বিশ্বাস করে না, বেশির ভাগ ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই শোষিত। এই শোষিত মানুষই বামপন্থীদের ক্লায়েন্ট। ধর্ম নিয়ে কোন চর্চা না করায় তারা তাদের ক্লায়েন্টদের একটি বড় অংশকেই দূরে সরিয়ে রেখেছে। তাই আমাদের জানতে হবে ধর্মের ইতিহাস। অন্তত যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
– তাহলে কি ধর্ম কখনও পজিটিভ রোল প্লে করেছে?
– করেছে কেন? এখনও করে। সেটা অবশ্য নির্ভর করে রাষ্ট্র কিভাবে সেটা কন্ট্রোল করে। রাশিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে ধর্মীয় সংস্থার সাহায্য নেয়া হয়। খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধানদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়, বুঝতে দেয়া হয় যে সমাজে গঠনমূলক কাজে তারাও অবদান রাখতে পারে। যেকোনো রাষ্ট্রে সমস্ত সম্প্রদায়ের লোকই তার নাগরিক। রাষ্ট্র যদি সবার প্রতি সমান গুরুত্ব দেয় তাহলে সমস্যা কম হয়। সোভিয়েত আমলে কাউকে পাত্তা দেয়া হত না, ফলে যারা ধর্মে বিশ্বাস করত তারা রাষ্ট্র থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করত। এখন রাষ্ট্রের ব্যবহার বদলে গেছে, ফলে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষও নিজেদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে, যেমন মনে করে অবিশ্বাসীরা। দেশের সব নাগরিককে রাষ্ট্রের অংশীদার করাই তো যেকোনো রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। তাছাড়া সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অন্যান্য সব কিছুর মত সুস্থ ধর্ম চর্চা আবশ্যক। এছাড়া মনে রাখতে হবে ধর্ম শুধু প্রথাগত ধর্ম নয়। অন্ধবিশ্বাসে এমনকি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বিজ্ঞান এসব ধর্মের আকার ধারণ করে। তাছাড়া এক সময় ধর্মই ছিল সমাজের চালিকা শক্তি।
– সেটা আবার কীভাবে?
– কয়েক বছর আগে আমি “আকাশ ভরা সূর্য তারাঃ কসমোলজির সেকাল একাল” নামে একটি বই লিখেছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই এ জন্য অনেক পড়াশুনা করতে হয়। এর আগে যে ধর্ম সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানতাম না তা নয়, কিন্তু প্রাচীনকালের কসমোলজি নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েই প্রথম দেখি কীভাবে মানুষের জানার ইচ্ছা শুধু বিজ্ঞানের জন্ম দেয়নি, ধর্মেরও জন্ম দিয়েছে। আসলে আজ আমরা যখন দেখি খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ এসব ধর্মের কোটি কোটি অনুসারী তখন মনে হতে পারে সব সময়ই এমনটা ছিল। আসলে সব ধর্মই শুরুতে ছিল যাকে এখন আমরা বলি সেক্ট। সমাজে প্রচলিত অবস্থার পরিবর্তন করতে গিয়ে অনেকেই বিভিন্ন ধারণা নিয়ে এসেছে। ফলে সারা বিশ্বে এখনও কয়েক হাজার ধর্ম বিদ্যমান ঠিক যেমন বিদ্যমান নানা রকমের আদর্শ ও দর্শন। এখন প্রশ্ন হল কেন তারা ঈশ্বরকে ঘিরে এসব করেছে? এখন আমরা যখন কোন বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখি তখন এর আগে যারা এসব বিষয়ে কাজ করেছেন তাদের কাজের উদ্ধৃতি দেই। একজন শিশু যেমন তার সমবয়সীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তার বাবা বা অন্য কারো উদ্ধৃতি দেয় একই ভাবে আমরা আইনস্টাইন, হকিং, নিউটন, সক্রেটিস, প্ল্যাটো, মার্ক্স, লেনিন এদের উদ্ধৃতি দেই। এতে আমাদের ধারণার প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারি। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন সমাজে গ্রহণযোগ্য কেউ ছিল না, সবাই ছিল সমান। তাই তারা কপ্ন অজানা শক্তি বা ঈশ্বরের উদ্ধৃতি দিত। আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের প্রতিবেশী এক ছেলে হঠাৎ মাঝে মাঝে গড়াগড়ি দিয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করল। হতে পারে মৃগী রোগ বা অন্য কিছু। কিন্তু ওর মা বলতে শুরু করল ওর উপর শিব ভর করেছে। ফলে সবাই আসত তাদের ভবিষ্যৎ জানার জন্য। যদি আমাদের কথা অন্যদের বিশ্বাস করাতে চাই তাহলে হয় নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নয়তো এমন কারও বরাত দিয়ে বলতে হবে যার শক্তিতে মানুষ বিশ্বাস করে। নিজেদের ধারণা সমাজে গ্রহণযোগ্য করার জন্য প্রাচীন আমলে তাই দেবতাদের বা অদৃশ্য শক্তির সাহায্য নেয়া হত। আসলে দেব দেবতা কখনোই ছিল না, কিন্তু মানুষ দুর্বল ছিল, ক্ষুদ্র ছিল তার জানার পরিধি। তাই সে প্রতিবাদ করতে ভয় পেত। দেবতার বাণী হিসেবে মেনে নিত এসব মানুষের কথা যারা প্রায়ই নিজেদের প্রেরিত পুরুষ হিসেবে দাবি করত। তবে এলাকা ভেদে এখানেও ভিন্নতা দেখা যায়। বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি গ্রন্থ মানুষের তৈরি, যেমন বুদ্ধের বাণী। অন্য দিকে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা কোরআন নবীদের মাধ্যমে মানুষের কাছে এলেও বলা হয় এসব ঈশ্বরের বাণী। তবে যেভাবেই আসুক, এসব বাণী সমাজের প্রয়োজনেই তৈরি হয়েছে আর সমাজে এদের চাহিদা ছিল বলেই তা টিকে গেছে। মানুষ যদি এসব গ্রহণ না করত তাহলে অনেক কিছুর মত এসব বানীও হারিয়ে যেত। নতুন বাণী মানেই নতুন আইডিয়া। ফলে জন্মের প্রাক্কালে এসব ধারণা সমাজে অনেক ভালো পরিবর্তন বয়ে আনে। কিন্তু এক সময় সেই সংস্কার যখন অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হল তা আর সংস্কার থাকল না, হল কুসংস্কার। তবে এর জন্য ধারণা দায়ী নয়, দায়ী সেই সব মানুষ যারা এটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে মানুষকে ধোঁকা দেবার জন্য।
তাছাড়া একটু খেয়াল করলে দেখব ধর্মের সাথে সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রাচীন সভ্যতার যেসব নিদর্শন আমরা পাই তার প্রায় সবকিছুই কমবেশি ধর্মের সাথে জড়িত। এমনকি শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত এসব সৃষ্টি হত ধর্মকে কেন্দ্র করে। গুহা মানব মূলত আঁকত জীবজন্তুর ছবি। তবে প্রাচীন কালের অনেক দেবদেবীকে জীবজন্তুর আকারে কল্পনা করা হত। সেটা মিশরেই হোক আর ভারতেই হোক। মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ এসব ভারতে বিষ্ণুর অবতার। আর চার্চ মানেই তো ছবি আর ছবি। এছাড়া যদি লক্ষ্য করি দেখব প্রাচীন কালে শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে। হয়তো গ্রীক সভ্যতা ব্যতিক্রম। প্রাচীন ভারতে শিক্ষা হত আশ্রমে। বৌদ্ধ বিহার বা প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মীয় কলাকানুনের সাথে অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষা চলত। এক সময় সঙ্গীত মানেই ছিল উপাসনার গান, গানের মধ্য দিয়ে দেবতার বন্দনা করা হত। এখনও অধিকাংশ ধর্মেই প্রার্থনা করা হয় সুর করে। তাছাড়া যেসব স্থানে ধর্মের উৎপত্তি সে এলাকার ভৌগলিক পরিবেশ এসব ধর্মের রীতিনীতিতে অনেক ছাপ রেখেছে। আমার ধারণা ইসলাম যে চান্দ্র পঞ্জিকা অনুসারে চলে তার একটা প্রধান কারণ আরব দেশে চাষাবাদ হয় না, বরং চাঁদের অবস্থানের উপর নির্ভর করে মরুভূমিতে তখন কাফেলা চলত। তাই যেখানে চাষাবাদ হয় সেখানে সূর্যের গুরুত্ব চন্দ্রের চেয়ে বেশি আর আরবে উল্টো। তাই সেখানে ধর্মীয় জীবন চলে চাঁদের গতবিধির উপর নির্ভর করে। বিভিন্ন দেশে এমনকি শত বর্ষ আগেও বিভিন্ন উপাসনালয়ে শুধু বিয়েই হত না, সেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যু ও অন্যান্য ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে রাখা হত। বিভিন্ন দেশের লোকজ সংস্কৃতির সাথেও ধর্ম জড়িত। অথবা বলা যায় প্রাচীন কালের ধর্মীয় রীতিনীতি ধীরে ধীরে লোকজ সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। তাই ধর্ম আমাদের রক্তে মিশে আছে। এখন কথা হল কিভাবে সেটা মানুষকে বোঝানো এবং ধর্মকে সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। উন্নত দেশে সেটা অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছে। ফলে এসব দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা কম। তবে অনেক দেশেই ধর্মই যে তাদের সংস্কৃতির শেকড় সেকথা মানুষ ভুলে গেছে, সেখানে শুরু হয়েছে সব কিছুকে অস্বীকার করার প্রক্রিয়া। আসলে অতিরিক্ত কোন কিছু ভালো নয়। যখন আমরা বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারব তখনই এসব সমস্যা আপনা থেকেই দূর হয়ে যাবে। মনে পড়ে সোভিয়েত আমলের কথা। আমি আর আমার রুমমেট শ্রীকুমার গির্জায় যেতাম বেড়াতে। যেতাম বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে। সেখানে মূলত থাকতেন বৃদ্ধা মহিলারা। আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতেন। আবার হঠাৎ রাস্তায় কাউকে পাদ্রীর পোশাকে দেখলে অনেকেই কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকাত। এখন আমি যখন গির্জায় গিয়ে ছবি তুলি কেউ তাকিয়েও দেখে না বা রাস্তাঘাটে যখন কেউ ধর্মীয় পোশাকে ঘুরে তাদের দিকেও কেউ তাকিয়ে দেখে না। অর্থাৎ এখন আর এখানে কেউ কে ধার্মিক আর কে নাস্তিক এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। যখন সমাজে এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যখন সমাজের কোন সদস্য তার বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের জন্য নিজেকে অপাংক্তেয় মনে করে না তখন বলা যায় সমাজ সুস্থ। সেটা তখনই সম্ভব যখন আমরা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান করব। পৃথিবীতে হাজার হাজার আইডিয়া জন্ম নিয়েছে, কোনটা টিকে গেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি হারিয়ে গেছে। সমাজের জন্য ক্ষতিকর আইডিয়া যে নেই তা নয়, তবে অনেক ভালো আইডিয়াও খারাপ হয় মানুষের হাতে। কারণ কেউ যখন শুধু নিজের স্বার্থে কোন আইডিয়া ব্যবহার করতে শুরু করে তখন দুই দিন আগে হোক আর দুই দিন পরে হোক সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মূল কথা সময়ের সাথে নিজেকে বদলানো। যে আইডিয়া সেটা করতে পারে না, ইচ্ছা অনিচ্ছায় সেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো