মতামত

পদ্মা ব্রিজ, হিরো আলম এবং  অতঃপর

– উৎপল দত্ত

দুর্ভাগ্যবশতঃ হিরো আলম সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছুই জানি না। তার কোন গান আমার দেখা হয় নি কখনোই। তবে ফেসবুকে গেলেই হিরো আলম এর নাম দেখা যায়। শুনেছি তার নামে একটা ইউটিউব চ্যানেল ও আছে। কয়েকদিন আগে শুনলাম সে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছে তার নিজের মত করে। সুর বিকৃতি ঘটিয়েছে যথেষ্ট। এর জন্য পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল থানায় পরবর্তীতে  রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল

গীতি গাইবেনা এই মর্মে মুচলেখা নিয়ে ছেড়েছে। কয়েকদিন ধরে এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমন কি মূলধারার ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং  প্রিন্ট মিডিয়াতেও প্রচুর চর্চা হচ্ছে । আমাদের সুশীল সমাজের অনেকেই এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছেন; বাক স্বাধীনতা, সরকারের এক্তিয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গ সামনে আনছেন ।

কয়েকদিন আগে পদ্মা ব্রিজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে মূলধারার সব গণ মাধ্যমে একধরণের উন্মাদনা দেখেছি আমরা। আমাদের এই উন্মাদনা খুবই স্বাভাবিক। এত বড় একটা কান্ড হল, জাতি উদযাপন করবেনা তা কি করে হয়? আর এই ব্রিজ নির্মাণের কৃতিত্ব তো পুরোপুরি গণ- মানুষের। কেননা এই ব্রিজ তৈরী হয়েছে প্রকৃত পক্ষে জনগণের অর্থে । আর  এর সাথে মিশে আছে হাজার হাজার শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম। নিশ্চয় এই ব্রিজের উদ্বোধন বাঙালি জাতি উদযাপন করবে। এই ব্রিজ নিয়ে সামজিক মাধ্যম, মূলধারার গণ মাধ্যমেও শুরু থেকেই চর্চা হয়েছে। উদ্বোধনের আগেও হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ বিশেষ করে সুশীল সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এই বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। যা দেননি তা হচ্ছে যাদের শ্রমে-ঘামে- অর্থে এই সেতু তৈরী হয়েছে সেইসব  সাধারণ মানুষকে অভিনন্দন-অভিবাদন।

এই দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের আরো কিছু ঘটনা আড়াল হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সরকার – সুশীল সমাজ, গণ মাধ্যম কেউ এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব বেশি চর্চা করেছেন বলে অনেকের মনে হয় নি। অথবা এটা বলা যায় উপরের দুটো ঘটনা যে ভাবে চর্চিত অন্য কোন ঘটনা সে ভাবে নয়। অথচ ঐ ঘটনা গুলোর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয় বরং বেশি।

প্রথমতঃ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের অপমান, হামলা করার ঘটনা ঘটেছে এই সময়কালে এবং একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় এই শিক্ষকদের সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।

তাহলে একটু পেছন থেকেই দেখি। তবে খুব পেছনের কথা নয়। ২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়নগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি স্কুলের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ধরকে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির (?) অভিযোগে স্থানীয় একজন সাংসদ কান ধরে উঠ বোস করান। নির্যাতনের ফলে ঐ শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে দুই মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়।

এই ঘটনার মাত্র ৬ বছর পর ২০২২ সালে এসে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। মার্চ মাসে মুন্সিগঞ্জের একটি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে একই কারণ অর্থাৎ ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগে লাঞ্ছিত করা হয়।  এপ্রিল মাসেই দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধা দেয়ার মিথ্যে অভিযোগ আনা হয়। এরপর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উন্মেষ রায়ের শাস্তির দাবি তুলে আন্দোলন করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। জুন মাসের ১৮ তারিখ নড়াইলের কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা দিয়ে লাঞ্চনা করা হয়। অভিযোগ তিনি ধর্ম অবমাননাকারীর পক্ষ নিয়েছেন। এই জুন মাসের ২৫ তারিখ আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে প্রকাশ্যে তারি ছাত্র ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে।

শিক্ষক নির্যাতন ও অবমাননার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার দেখলাম জুলাই মাসের ১৫ তারিখ নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামের প্রায় ২ শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবারের উপর ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগে হামলা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, অগ্নি সংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা এই সরকারের আমলে নতুন কোন বিষয় নয়। তা আমরা রামু, নাছিরনগর, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী জেলায় ঘটতে দেখেছি ।

শিক্ষকদের  উপর হামলা কিম্বা নড়াইলের ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব অল্প চর্চা হতে দেখেছি। মূলধারার গণ মাধ্যমে খুব বেশি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমাদের সুশীল সমাজও এই বিষয় নিয়ে আশ্চর্য জনক ভাবে নিরবতা পালন করেছেন। তাদের কেউ কেউ আবার এইগুলোকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঘটনা হিসাবে দেখছেন।

এই যে সংখ্যালঘু শিক্ষক এবং নড়াইলে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটলো তা কিন্তু আজকাল কোথাও আলোচনার মধ্যে নেই। সেখানে ছিল প্রথমে পদ্মা সেতু নিয়ে উন্মাদনা, আর এখন প্রধান আলোচনার বিষয় হিরো আলম। এখানেই আমরা দেখতে পাই শাসক গোষ্ঠী ও তার স্বার্থ রক্ষাকারী গোষ্ঠী এবং গণ মাধ্যমের চাতুরী। এই অপকৌশল বা চাতুরী বাংলাদেশে নতুন কোন বিষয় না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক সরকারও তাদের মিত্রদের এই ধরণের অপ-কৌশল গ্রহণ করেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের ইতিহাস তো খুব বেশিদিনের নয়।

কিন্তু এই ধরণের অপ কৌশল গ্রহণ করে কি কোন সরকার ক্ষমতা রক্ষা করতে পারে বা পেরেছে? বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। যে অঙ্গীকার নিয়ে  মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তা থেকে অনেক পিছিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে আমাদের অবস্থান। বর্তমান শাসক গোষ্ঠী অন্ধকারের বিভিন্ন শক্তির সাথে আপোষ করতে করতে দেশকে ক্রমশ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য দুর্নীতিবাজ লুঠেরা গোষ্ঠী, আমলা, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে একটা সমঝোতা তৈরী হয়েছে এবং এদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখেই দেশ চলছে। এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশের মূল সমস্যা বা ইস্যু আড়াল করার জন্য নতুন নতুন অরাজনৈতিক ইস্যুর সৃষ্টি করা হচ্ছে।

কাজেই আমরা হিরো আলম বা পদ্মা ব্রিজের মত উন্মাদনা সৃষ্টিকারী বিষয় ভবিষ্যতে আরো দেখবো, নতুন নতুন উন্মাদনা দেখবো।

কিন্তু  অতঃপর…?

অতীতের মতই এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যত দেবে।