চলমান সংবাদ

বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস প্রতি বছর ১২ জুন পালিত হয়, যা আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে শিশুশ্রমকে প্রতিরোধ করার জন্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটির গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ আমাদের দেশে এখনও লক্ষ লক্ষ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা তাদের শৈশব, শিক্ষা এবং ভবিষ্যতকে নষ্ট করছে।

শিশুশ্রমের বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি বড় সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন ধরনের শ্রমে নিযুক্ত রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। এলুমিনিয়াম, পরিবহণ,  ইটভাটা, চা বাগান, গৃহকর্ম, এবং রাস্তার হকার সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিকদের দেখা যায়।

শিশুশ্রমের কারণ

শিশুশ্রমের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, সামাজিক অসচেতনতা, এবং অর্থনৈতিক অসমতা অন্যতম। অনেক পরিবারই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে লাগাতে বাধ্য হয় শুধুমাত্র আর্থিক সংকটের কারণে। এছাড়াও, অনেক বাবা-মা শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন নয় বা সচেতন হলেও তাদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) শিশুশ্রম প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার শিশু শ্রম নিরসন কৌশলপত্র এবং জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করেছে, যেখানে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে কাজে নিযুক্ত করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

“কম্প্রিহেনসিভ চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম” এবং “ব্র্যাক” সহ বিভিন্ন প্রকল্প শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এগুলি শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের পুনর্বাসন এবং তাদের পরিবারের আর্থিক সহায়তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

শিক্ষা এবং সচেতনতার গুরুত্ব

শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিক্ষা এবং সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজের সকল স্তরে শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যালয়গুলিতে শিশুশ্রম সম্পর্কে আলোচনা, সামাজিক সংস্থা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম শিশুদের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এছাড়াও, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত আরও বিনিয়োগ করা। বিনামূল্যে শিক্ষা, স্কুলে খাবার সরবরাহ, এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের স্কুলমুখী করা সম্ভব।

কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব (CSR)

বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোরও শিশু শ্রম প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাদের সামাজিক দায়িত্ব (CSR) কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনে এবং তাদের পরিবারের আর্থিক উন্নয়নে সহায়তা করতে পারে। এছাড়াও, তারা তাদের সরবরাহ চেইন এবং কর্মস্থলে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করতে পারে।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

শিশুশ্রম প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন আইএলও, ইউনিসেফ, এবং বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে শিশুশ্রম নিরসনে। তারা বিভিন্ন প্রকল্প এবং কর্মসূচির মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

ভবিষ্যতের করণীয়

শিশুশ্রম নির্মূল করতে হলে সরকার, সমাজ, পরিবার, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

  • শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বিনামূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
  • আর্থিক সহায়তা: দরিদ্র পরিবারগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে যাতে তারা শিশুদের কাজে না লাগায়।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
  • কঠোর আইন প্রয়োগ: শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার জন্য বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
  • পুনর্বাসন কার্যক্রম: শিশুশ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে আমাদের সকলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একমাত্র সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি এবং আমাদের শিশুদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে পারি।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)