চলমান সংবাদ

বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৪): যুদ্ধের কূটনীতি

-বিজন সাহা

ভ্লাদিমির পুতিন ভিয়েতনাম সফর শেষ করলেন। দুই দেশের মধ্যে বেশ কিছু স্ট্র্যাটেজিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। ভিয়েতনাম – সমাজতান্ত্রিক দেশ, এক সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পথে তিনি উত্তর কোরিয়া সফর করেছেন। যখন পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে, বিশেষ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে আইসোলেটেড দেখানোর চেষ্টা করছে তখন এ ধরণের সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে যে এর আগে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুতিনের উপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে রেখেছে। যে কারণে তিনি গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিক্সের সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁকে উপযুক্ত গ্যারান্টি না দিতে পারায়। যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের ভিয়েতনাম সফর, বিশেষ করে মহাসমারোহে তাঁকে বরণ করার বিষয়টা হজম করতে না পারার বিষয়টি জানিয়েছে। তবে এখন যে এই আমেরিকা সেই আমেরিকা নেই এসব ছোট ছোট ঘটনা তারই প্রমাণ।

আসলে যখন থেকেই ইউক্রেনের পরাজয় দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে, যখন পশ্চিমা বিশ্বের হাজারো নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে রাশিয়ার অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে আর তাদের পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র মাঠে মারা যাচ্ছে, তখন থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব মরিয়া হয়ে উঠেছে আর কি করা যায় রাশিয়ার অগ্রগতি থামানোর জন্যে। আগে যে সমস্ত সমরাস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো হত না এখন সেগুলো পাঠানো হচ্ছে, এমনকি সেসব অস্ত্র শুধু প্রতিরক্ষার জন্য নয়, রাশিয়ার বিভিন্ন শহর আক্রমণ করার অনুমতিও দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। এতদিন যে করত না তা নয়, তবে তখন অন্তত লোক দেখানো হলেও ইউক্রেন সেটা করত নিজ দায়িত্বে, এখন করবে পশ্চিমা বিশ্বের সম্মতিতে। মনে রাখতে হবে যে এসব অস্ত্র আসলে ব্যবহার করে পশ্চিমা সমরবিদরাই, ইউক্রেন শিখণ্ডীর ভূমিকা পালন করে মাত্র। এসব প্রশ্ন তাই বারবার সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে কিছুদিন আগে সমাপ্ত পিতেরবুরগ ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক্যাল ফোরামে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেরগেই কারাগানভ, যিনি একাধিকবার সীমিত পারমানবিক যুদ্ধের কথা বলেছেন, পুতিনকে জিজ্ঞেস করেন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা। একই ধরণের প্রশ্ন আসে পশ্চিমা সাংবাদিকদের কাছ থেকে। পুতিন বলেন সেই সম্ভাবনা এড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ রাশিয়া যদি মনে করে তার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন তাহলে কোন উপায় থাকবে না। তিনি আরও বলেন ইউরোপের জন্য সেটা হবে খুবই বিপদজনক, কারণ ইউরোপ খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। তবে তিনি যুদ্ধ সে পর্যায়ে যাবে না বলেই আশা প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয় তিনি ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে শত্রু ভাবাপন্ন বিভিন্ন দেশকে উন্নত ধরণের অস্ত্র সরবরাহের কথাও ভেবে দেখছেন বলে জানান। এ সময়েই ট্যাক্টিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্রের এক মহড়া হয়। এক কথায় পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝতে দেন যে রাশিয়া সমস্ত শক্তি দিয়ে তার স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে প্রস্তুত।

এরপর ইউক্রেন সুইজারল্যান্ডে এক শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে। শেষ পর্যন্ত এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নেতারাই সেখানে উপস্থিত হননি। রাশিয়াও বসে ছিল না। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় গ্লোবাল সাউথের খুব কম দেশই সেখানে অংশ নেয়, নিলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির কূটনীতিকরা সেখানে অংশ নেয়। তবে এমনকি পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে ইউক্রেনের শান্তি সম্মেলন ব্যর্থ হয়েছে। আসলে যেটা হয়েছে তা হল এই সুযোগে রাশিয়ার সমালোচনা আর জেলেনস্কির আরও আরও অস্ত্র চাওয়া। শোনা যায় যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের এক বিরাট অংশ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন অস্ত্র কারখানার প্রতিনিধিরা। যতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ লাভজনক ততদিনই এটা চালিয়ে যাওয়া হবে। এটা অনেকটা আমাদের দেশে রুগী মরণাপন্ন জেনেও (শুনেছি মারা যাবার পরেও অনেক সময় এমনটা ঘটে) তাকে আইসিইউতে আরও কিছুদিন রেখে টু পাইস কামাই করার মত।

ইউক্রেনের আহ্বানে শান্তি সম্মেলন শুরু হবার আগে ভ্লাদিমির পুতিন কিছু পুরানো গোপন তথ্য প্রকাশ করেন। এর আগে ইস্তানবুলে দুই দেশ যে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন। শুধু তাই নয় ইউক্রেনের পক্ষ থেকে যারা সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তারাও বলে যে ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনসনের চাপে সেই চুক্তি থেকে তারা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তবে বরিস জনসন যে আমেরিকার নির্দেশেই সেটা করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেই চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া কিয়েভের উপকণ্ঠ থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে আনে। কথা হয়েছিল কিয়েভ দানিয়েৎস্ক ও লুগানস্ক থেকে সেনা সরিয়ে নেবে, নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে ইত্যাদি। সেটা হলে দেশ আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হত না, প্রায় পাঁচ লাখ ইউক্রেন সেনা মারা যেত না। এরপরে ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শান্তি বার্তা নিয়ে আসেন পুতিনের কাছে। সেই সময় হেরসন ও জাপারোঝিয়ের অনেকটাই এদের দখলে। তখন কথা হয়েছিল ইউক্রেন সেনা উঠিয়ে নেবে, রাশিয়াকে স্থলপথে ক্রিমিয়া যাতায়াতের সুযোগ দেবে যা আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা কার্যকরী করা হবে। সেই সাথে নিরপেক্ষতা ইত্যাদি। তাতে রাজী হয়নি। এবার পুতিন বললেন, এমনকি এখনও রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজী। শর্ত – সেই নিরপেক্ষতা ও চারটি প্রদেশে রাশিয়ার অধিকার মেনে নেয়া। কারণ এসব এলাকার জনগণ ভোটের মাধ্যমে রাশিয়ায় যোগ দিয়েছে। রাশিয়া মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে বদ্ধপরিকর। ওয়াশিংটন বলেছে যে সেই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে যুদ্ধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে অ্যামেরিকান মিলিটারী ইন্ডাস্ট্রি ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর সাধারণ মানুষ? পুঁজিবাদ সাধারণ মানুষের কথা কখন ভেবেছে?

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১৫৩):ভারতে নির্বাচন ও আমরা - বিজন সাহা

রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সাথে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করেছে যার অন্যতম প্রধান এক দেশ আক্রান্ত হলে অন্য দেশ তার রক্ষায় এগিয়ে আসবে। ১৯৬১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে এ ধরণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯০ এর দশকে তা অবশ্য বিলোপ পায়। এই চুক্তির ফলে আমেরিকার পক্ষে এখন আর চাইলেই উত্তর কোরিয়া আক্রমণ করা সম্ভব হবে না। রাশিয়া এখন শুধু পশ্চিম সীমান্তেই নয়, পূর্ব সীমান্তেও নিজের অবস্থান শক্তিশালী করল। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য করার ফলে এই এলাকাও রাশিয়ার বৈরী এলাকায় পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠছে উত্তর কোরিয়ার উপর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার। কারণ এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধু মাত্র সাধারণ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে।

রাশিয়া পশ্চিমা দেশের শত্রু ভাবাপন্ন দেশগুলোয় অস্ত্র সরবরাহের কথা চিন্তা করবে এই ঘোষণার পর থেকে ইয়েমেন থেকে পশ্চিমা জাহাজে আক্রমণ অনেকটাই বেড়েছে। আমেরিকাও সেখানে হামলা চালিয়েছে। রাশিয়ার যুদ্ধ জাহাজ কিউবার উপকূলে এসে পৌঁছেছে, সাথে পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন। এসব জাহাজে ৎসিরকন সহ বিভিন্ন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন আছে বলে শোনা যায়। অন্য দিকে ডেনমার্ক রুশ জাহাজের জন্য বারেন্সভো সাগর বন্ধ করবে বলে জানিয়েছে। সেটা খুবই ভয়াবহ। আমেরিকা যতই বলুক ইউরোপকে রক্ষা করবে, কিন্তু যুদ্ধ যদি পারমাণবিক আকার ধারণ করার সম্ভাবনা থাকে তারা মোটেই কোন রিস্ক নেবে না।

মনে পড়ে পুতিন ক্ষমতা নেবার পরেই ভিয়েতনামে রুশ সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা হয়। কামরাং থেকে শেষ বিমান এদেশে চলে আসে। জানি না এবার সেই ঘাঁটি নতুন করে চালু করার ব্যাপারে কথা হবে কি না। ইতিমধ্যে এদেশের বাণিজ্যের ৪০% রুবলে হচ্ছে, ডলারের উপর নির্ভরতা সর্বনিম্ন। অন্যান্য দেশও জোর কদমে ডলারের উপর তাদের নির্ভরতা কমিয়ে আনছে। পশ্চিমা দেশ এমনকি মস্কো স্টক একচেঞ্জের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আসলে সব দেখে মনে হয় পশ্চিমা বিশ্ব আজ দিশেহারা। তারা জানে না কীভাবে রাশিয়াকে ঠেকাতে হবে। সেখানকার সমস্ত দেশেই তাদের পলিসি পরাজিত, ভোটে জিতছে বিরোধীরা। হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের কাছে হেরে গেলে বারাক ওবামা অফিস ত্যাগের মাত্র কয়েক দিন আগে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে স্থবির অবস্থায় নিয়ে আসেন প্রচুর পরিমাণ কূটনীতিকদের বহিষ্কার করে। এসব পরাজিত নেতারা বিদায়ের আগে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

ঈশ্বর যখন পাপীদের শাস্তি দিয়ে নরকে চালান করেন তিনি ভাবেন না যে নরকবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লড়তে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকা যখন বিভিন্ন দেশকে নরকে অবরোধ করে রাখে বলে মনে করে, তারাও ভাবে এরা শান্ত ছেলের মত ওখানে বসে দিন কাটাবে, নিজেরা মিলে মিশে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না। কিন্তু যখন রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান এসব দেশ পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তখন পশ্চিমারা অখুশি হয়। কেন? কারণ ওদের ঈশ্বরের রাজ্যে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।

ভিয়েতনামে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক পরাজয় ঘটানো সম্ভব নয়, কারণ এর অর্থ রাশিয়ার অস্তিত্ব বিলোপ পাওয়া। «যে বিশ্বে রাশিয়া নেই সেই বিশ্ব দিয়ে আমাদের কী হবে» – এই কথাগুলি তিনি বলেছিলেন কয়েক বছর আগে। এর মধ্য দিয়ে তিনি আবারও বুঝিয়ে দিলেন পশ্চিমা বিশ্ব যদি ইউক্রেনের কাঁধে বন্দুক রেখে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চায় সেটা হবে তাদের আকাশ কুসুম কল্পনা – কারণ সেক্ষত্রে পশ্চিমা বিশ্বের অস্তিত্বও বিলুপ্ত হবে। এটা খুবই শক্তিশালী বার্তা, কেননা পশ্চিমা বিশ্বের সমস্ত ক্যালকুলেশনের মূলে আছে যে রাশিয়া শেষ পর্যন্ত কিছুই করবে না, তাই এদেশকে যত খুশি খোঁচানো যায়। বিগত কয়েক সপ্তাহের বার্তা পশ্চিমা বিশ্বের এই ধারণা যে সঠিক নয় সেটা বুঝিয়ে দেবার জন্য।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো