মতামত

একজন মা শ্রমিকের গল্প: নাজমা বেগমের সংগ্রাম

-ফজলুল কবির মিন্টু

নাজমা বেগম (ফাইল ছবি)

নাজমা বেগম, একজন সাহসী মা এবং পোশাক কারখানার শ্রমিক, যিনি রিজী এপারেলস নামের একটি কারখানায় সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন। ১ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে তিনি এই কারখানায় যোগদান করেন। ২০১৯ সালে তিনি সন্তান সম্ভবা হন। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি ছিল তার সন্তান জন্মদানের সম্ভাব্য তারিখ। কিন্তু নাজমার মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হতেই, তার জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
কারখানার জনৈক পার্সোনাল অফিসার সরোয়ার তাকে ডেকে জানান যে, এই কারখানায় মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার কোন রেওয়াজ নেই। উপরন্তু, তিনি নাজমাকে চাকরি থেকে রিজাইন দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। নাজমা রিজাইন দিতে অস্বীকৃতি জানালে, সরোয়ার সাহেব তার কাছ থেকে জোরপূর্বক আইডি কার্ড কেড়ে নেন এবং সাদা কাগজ ও দুটি ফরমে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে বলেন, “তোমার রিজাইন হয়ে গেছে। তুমি আগামী ৭ নভেম্বর ২০২৯ তারিখে এসে বেতন নিয়ে যেও।”

সাহায্যের জন্য সংগ্রাম

নাজমা এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শ্রমিকনেতা আব্দুল ওয়াদুদ জীবনের মাধ্যমে বিলস কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক ফজলুল কবির মিন্টুর শরণাপন্ন হন। জনাব মিন্টু রিজী এপারেলস কর্তৃপক্ষকে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানালে, তারা নাজমার মাতৃত্বকালীন ছুটি বাতিলের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে। ফলে নাজমা শ্রম আইন অনুসারে প্রথম ৫৬ দিনের বেতন পেয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে সক্ষম হন। কিন্তু সন্তান প্রসবের পরবর্তী ৩ দিনের মধ্যে বাকি ৫৬ দিনের বেতন পরিশোধ করার নিয়ম থাকলেও, তা করা হয়নি।
কাজের পরিবেশ এবং অন্যায্যতা
নাজমা প্রসব পরবর্তী ৫৬ দিন পার করে, ফজলুল কবির মিন্টুর পরামর্শে সন্তানসহ কাজে যোগদান করতে গেলে প্রথমে সে দেখে কারখানায় কোনো ডে-কেয়ারর সেন্টার নেই। কর্তৃপক্ষ তাকে বাচ্চার কাঁথা-বালিশ নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেয়। নাজমা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুসরণ করে কাঁথা-বালিশ নিয়ে কয়েকদিন চাকরি করে। এরমধ্যে করোনা এসে যাওয়ায় তার বাচ্চা দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত শ্রমিকের চাকরি চলে যায় তখন কর্তৃপক্ষ নাজমাকে মজুরিসহ ছুটি দেয়।
এভাবে কিছুদিন চলার পর, ১২ অক্টোবর ২০২০ তারিখে কর্তৃপক্ষ আবারো তার আইডি কার্ড কেড়ে নিয়ে চাকরি থেকে বিতাড়িত করে। নাজমা আবারও অবিচারের শিকার হন।

সন্তানসহ নাজমা বেগম (ফাইল ছবি)

আইনি লড়াই

পরবর্তীতে, নাজমা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর সহযোগিতায় এবং শ্রমিক নেতা ফজলুল কবির মিন্টু ও আব্দুল ওয়াদুদ জীবনের পরামর্শে চট্টগ্রাম শ্রম আদালত-২ এ মামলা দায়ের করেন। নাজমার পক্ষে প্রথমে মামলা দায়ের করেন এডভোকেট জানে আলম। কিন্তু দুর্ভাগ্য করোনা মহামারির শিকার হয়ে তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন এবং পরবর্তীতে তার পক্ষে তারই সুযোগ্য কন্যা এডভোকেট ফারাহানা আলম এনি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর তথা ১২২৭ দিন মামলায় লড়াই করার পর, ২১ মার্চ ২০২৪ তারিখে মামলার রায় পান। রায়ে শ্রমিক পক্ষের অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হওয়ায়, নাজমাকে চাকরির ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সপদে এবং সবেতনে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়।
শুভঙ্করের ফাঁকি
মামলায় আপাতত শ্রমিক পক্ষের জয় হলেও, নাজমা দুটি প্রধান কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রথমত, রায় পেতে নির্ধারিত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সময় লেগেছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২১৬ তে উল্লেখ আছে যে, মামলা দায়ের করার ৬০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করতে হবে। যদি কোন কারণে ৬০ দিনের মধ্যে রায় প্রদান করা সম্ভব না হয়, তবে বিচারক যথাযথ কারণ উল্লেখপূর্বক আরও ৯০ দিন সময় বর্ধিত করতে পারবেন। অর্থাৎ, সর্বোচ্চ ১৫০ দিনের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নাজমার রায় পেতে ১২২৭ দিন সময় লেগেছে, যা শ্রমিকের প্রতি অন্যায়।
দ্বিতীয়ত মামলা চলাকালীন সময়ে তিনি কর্মহীন এবং আয়রোজগারহীন ছিলেন। রায়ে বলা হয়েছে, ১২২৭ দিন বিনা বেতনে ছুটি বিবেচনা করতে। এটি নিঃসন্দেহে শ্রমিকের প্রতি অবিচার হয়েছে। বিচার চাইতে গিয়ে নাজমা অবিচারের শিকার হয়েছেন, পক্ষান্তরে মালিক আইন ভঙ্গ করে পুরস্কৃত হয়েছেন।

শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা

নাজমার এই গল্পটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আইনি লড়াই অত্যন্ত জরুরি, তবে প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের যাতে ন্যায়বিচার দ্রæত পাওয়া যায় এবং দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানো যায়, তা নিশ্চিত করা উচিত। নাজমার মতো মা শ্রমিকরা যখন নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেন, তখন তাদের সাহস এবং দৃঢ়তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
নাজমার গল্পটি শুধু একটি ব্যক্তিত সংগ্রামের কাহিনী নয়, বরং এটি আমাদের শ্রমিক সমাজের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করে। আমরা এই কাহিনী থেকে শিক্ষা নিতে পারি এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য সকলে মিলে কাজ করতে পারি। শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার এবং তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের সমাজের নৈতিক দায়িত্ব।

সমাপ্তি

নাজমা বেগমের এই সংগ্রাম এবং তার আইনি লড়াই আমাদের সবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে আর কোনো নাজমাকে এই ধরনের অবিচারের শিকার হতে না হয়। আমরা সবাই মিলে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং তারা ন্যায়বিচার পাবেন।
(লেখক: কো-অর্ডিনেটর, জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্র, বিল্স-ডিটিডিএ প্রকল্প)