চলমান সংবাদ

যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টি প্রধানের বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশিরা

ব্রিটেনের বিরোধী দলীয় নেতা এবং লেবার পার্টি প্রধান কেয়ার স্টারমার। ছবি: রয়টার্স/জেসন কেয়ারন্ডফ

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘কটাক্ষ’ করে লেবার পার্টি প্রধান কেয়ার স্টারমারের দেয়া বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিরা৷ প্রতিবাদ জানিয়ে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত এক নারী কাউন্সিলর৷

মঙ্গলবার (২৫ জুন) যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ডেইলি সা‌ন আ‌য়োজিত এক‌টি বিতর্কে অংশ নেন লেবার পার্টির নেতা৷

সেখানে তিনি অভিবাসীদের ‘বহিষ্কার প্রক্রিয়া’ নিয়ে কথা বলেন৷ তার বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে৷

ডেইলি সান আয়োজিত বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের রুয়ান্ডা পরিকল্পনা এবং অনিয়মিত অভিবাসনের বিষয়টি উঠে আসে৷

সেখানে উপস্থিত এক দর্শক বলেন, ‘‘অনেক অনিয়মিত অভিবাসীরা যুক্তরাজ্যে আসার পর পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথি নষ্ট করে ফেলে, যাতে তাদের শনাক্ত করা না যায়৷ আপনি যদি না-ই জানেন যে তারা কোন দেশ থেকে এসেছেন, তাহলে তাদের কোথায় পাঠাবেন?’’

এমন প্রশ্নের জবাবে কেয়ার স্টারমার বলেন, ‘‘এটি অবশ্যই কঠিন৷ অভিবাসীরা কোথা থেকে এসেছেন সেটি আপনাকে অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে৷ তবেই আপনি তাদের মূল দেশে ফেরত পাঠাতে পারবেন৷ আমাদের এটির সমাধান করা দরকার৷’’

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এক পর্যায়ে স্টারমারের কাছে ফের জানতে চান, ‘‘অভিবাসীদের পরিচয় শনাক্ত করা না গেলে তাদের কোথায় পাঠানো হবে?’’

জবাবে স্টারমার বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে যদি কেউ আসে, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না৷ কারণ এটি নিয়ে বর্তমান সরকারের তেমন কোনো প্রক্রিয়া নেই৷

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে এমন মন্তব্যের পর নিজ দলের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন দলপ্রধান৷ সমালোচিত হয়েছেন বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও৷

সমালোচনার জবাবে স্টারমার বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) আইটিভিকে বলেন, ‘‘আমি ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের অবিশ্বাস্য অবদানকে অবশ্যই মূল্যায়ন করি৷ আমরা যদি ভবিষ্যতে সরকারে আসি এই সম্পর্ককে এখনকার চেয়ে আরো শক্তিশালী করবো৷’’

‘বিতর্কিত’ মন্তব্যের ব্যাপারে এই রাজনীতিবিদ বলেন, ‘‘আমি মূলত আশ্রয়পার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ওই মন্তব্য করেছি৷ আমি কোনো উদ্বেগ তৈরি করতে চাইনি৷’’

 চলতি সপ্তাহে এক নির্বাচনী প্রচারণায় কেয়ার স্টারমার। ছবি: রয়টার্স/জেসন কেয়ারন্ডফ
চলতি সপ্তাহে এক নির্বাচনী প্রচারণায় কেয়ার স্টারমার। ছবি: রয়টার্স/জেসন কেয়ারন্ডফ

আশ্রয় আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ একটি নিরাপদ দেশ৷’’

এক কাউন্সিলরের পদত্যাগ

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীরা অভিবাসনপন্থি হিসেবে লেবার পার্টিকে সমর্থন দিয়ে আসছে৷ কেয়ার স্টারমারের এমন মন্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন দলটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করা ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের অনেকেই৷

এ ঘটনায় বুধবার নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে বিবৃতি দিয়ে লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর এবং স্থানীয় লেবার গ্রুপের ডেপুটি প্রধান সাবিনা আক্তার৷

এক্স প্ল্যাটফর্মে পোস্ট করা বিবৃতিতে এই নারী রাজনীতিবিদ বলেন, ‘‘আমাদের দলের নেতা যখন আমার সম্প্রদায়কে আলাদা করে এবং আমার বাংলাদেশি পরিচয়কে অপমান করে, তখন আমি আর এই দল নিয়ে গর্ব করতে পারি না৷’’

যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশিদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার টেলিফোনে এবং হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছে ইনফোমাইগ্রেন্টস৷ লেবার পার্টির স্থায়ী ভোটব্যাংক হিসেবে খ্যাত বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই এমন মন্তব্যে চরম হতাশার কথা জানিয়েছেন৷

ভোটারদের একজন ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, ‘‘আগামী ৪ তারিখ জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আমাদের পছন্দের দলের নেতার এরূপ মন্তব্যে আমরা বিস্মিত৷’’

অপরদিকে লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্রিটিশ বাংলাদেশি মিশ রহমান বৃহস্পতিবার আইটিভিকে বলেছেন, ‘‘আমি কেয়ার স্টারমারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করব না৷ যখনই দেখব তিনি দলীয় মূল্যবোধের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন তখনই প্রতিবাদ করব৷ সাম্প্রতিক ঘটনায় তিনি সীমা অতিক্রম করেছেন৷ এগুলো তার কাছে এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের সম্প্রদায় সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রীর এমন মনোভাব কখনো সহ্য করবে না৷ তিনি জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হবে সেটি ভুলে গিয়ে কথা বলেছেন৷ এমন পদক্ষেপ এই সম্প্রদায়ের অনেককেই স্বতন্ত্র ও গ্রিনস পার্টির দিকে যেতে বাধ্য করছে৷’’

এক্স-এ পোস্ট করা একটি ভিডিওতে লেবার পাটি থেকে নির্বাচনে লড়া সদ্য সাবেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি সংসদ সদস্য আপসানা বেগম বলেছেন, ‘‘আমি কখনও এমন বক্তব্যের সঙ্গে থাকব না এবং বাংলাদেশি অভিবাসী সম্প্রদায়কে বলির পাঁঠা হতে দেব না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশি অথবা অন্য কোনো অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বক্তব্যের ব্যবহার যেকোনো দলের জন্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য৷’’

২০২১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত৷

লেবার পার্টির এক মুখপাত্র সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘কেয়ার স্টারমারের বক্তব্যে মূলত বাংলাদেশকে নিছক উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি রয়েছে৷’’

বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য যুক্তি

ব্রিটেনের বর্তমান ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি গত মাসে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অনিয়মিত অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে একটি চুক্তিতে সই করেছে৷

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে এমন চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে ব্রিটেন৷

ফাস্ট-ট্র্যাক রিটার্ন ডিল বা দ্রুত প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় আশ্রয় আবেদন বাতিল হওয়া অনিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাবে ব্রিটিশ সরকার৷

যুক্তরাজ্য সরকারের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ক মন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ানের মধ্যে এক বৈঠকের ভিত্তিতে ওয়ার্কিং গ্রুপটি তৈরি হয়েছে৷

ওইসময় বাংলাদেশর প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, অনিয়মিত অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ বা ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতি রয়েছে৷ ওই সময় ফাস্ট-ট্র্যাক রিটার্ন চুক্তিতেও সম্মতি দেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান৷ এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানায় অ্যান-মেরি ট্রেভিলিয়ান৷

১৬ মে ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০২৩ সালে ১১ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, কাজের ভিসা এবং ভ্রমণ ভিসায় যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করে আশ্রয় আবেদন করেছে।

তবে যুক্তরাজ্যের রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান পলিসি এনালিস্ট জন ফেটনবি এই ১১ হাজার বাংলাদেশির আশ্রয় আবেদনের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০২৩ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশই আশ্রয় আবেদন দায়ের করেছেন৷ যাদের মধ্যে ভিসা ছাড়া অর্থাৎ অনিয়মিত উপায়ে আসা বাংলাদেশিরাও রয়েছেন৷

টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে অবশ্য বাংলাদেশি অভিবাসীদের ‘ভিসার অপব্যবহার’ এর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে৷

প্রথম তিন মাসে ‘ডিপোর্ট’ ১৪৪৬

ব্রিটিশ হোম অফিস ২৮ জুন ইমেইলে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছে, ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ব্রিটেন থেকে ডিপোর্ট করা হয়েছে এক হাজার ৪৪৬ জন অনিয়মিত অভিবাসীকে। যাদের মধ্যে তিন জন বাংলাদেশি অভিবাসীও রয়েছে।

এছাড়া প্রথম তিন মাসে ডিটেনশন সেন্টারে থাকা বাংলাদেশি বন্দির সংখ্যা ছিল ১৩ জন।

একই সময় এক বাংলাদেশিকে অপরাধী হিসেবে ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে বিমানবন্দর কিংবা অন্য সীমান্তে আসা ১৮ বাংলাদেশির প্রবেশ আটকে দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।

সবশেষ একই সময়ে ব্রিটেনে নাগরিকত্ব পেয়েছেন এক হাজার ৪১৫ জন বাংলাদেশি অভিবাসী।

এমএইউ/টিএম/আরকেসি