বিজ্ঞান ভাবনা (১৬১): রাজনীতির সত্য মিথ্যা – বিজন সাহা
রাজনীতিতে মিথ্যাচার নতুন কিছু নয়। এই মিথ্যা যে সব সময় সত্যি সত্যি মিথ্যা হতে হবে তার কোন মানে নেই, কিন্তু কিছু শব্দ এদিক ওদিক করে জনমতকে খুব ভালো ভাবেই প্রভাবিত করা যায়। অনেক সময় বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে তার দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়েও ফায়দা লুটা যায়। যেকোনো ঘটনার সত্যতা বজায় রেখেও তা বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ করা যায়। এ বিষয়ে আমি নিজের ছেলেমেয়েদের একটি গল্প শোনাই।
অনেক আগে ঢাকায় আমেরিকা ও সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেই প্রতিযোগিতায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জয়লাভ করেন। পরের দিন দুই দেশের পত্রিকায় এ বিষয়ে খবর বের হয়। ওয়াশিংটন পোস্ট লেখে “গতকাল ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রথম স্থান আর সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত সর্বশেষ স্থান অধিকার করেন।” একই খবর প্রাভদায় আসে এভাবে “গতকাল ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয় স্থান আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত শেষ দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।” ফরমালি কেউই মিথ্যা লেখেনি, তবে কতজন রাষ্ট্রদূত এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন সেটা না লেখায় দুই দেশের মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা পেয়েছে।
কিন্তু কথা হল আজ হোক আর কাল হোক সব কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়, নাহলে কোন না কোন সময় সত্যি কথাটা জনসম্মুখে চলে আসে। তাই অতীতের যেকোনো ঘটনা আমাদের যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানা দরকার তেমনি জানা দরকার বর্তমানে যা ঘটছে সেটাও। হাসিনা সরকারের পতনের পরে সেই আমলের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, গুম, খুন এসবের যেমন নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার, তেমনি গণ অভ্যুত্থানের সময়ে ও পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মৃত্যুর নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হওয়া একান্তই দরকার। সেটা এমনকি যদি বর্তমানে যারা ক্ষমতায় এসেছে তাদের বিরুদ্ধেও যায় তারপরেও এ বিষয়ে নিরপেক্ষতা দেশের ভবিষ্যতের জন্যই দরকার। মনে রাখতে হবে গণ বিপ্লবের মূল কথা ছিল বৈষম্য বিরোধিতা। ন্যায় বিচার ব্যতীত বৈষম্য দূর করা যায় না।
ইতিমধ্যেই জানা গেছে যে আন্দোলনের সময় যেসব মানুষ নিহত হয়েছে তাদের অনেকেই মারা গেছে ভিন্ন ধরণের গুলীতে। রিপোর্ট বলছে আন্দোলনের একজন আইকনিক শহীদ মুগ্ধ মারা গেছে ৭.৬২ বুলেটে। তাই প্রশ্ন উঠেছে কারা সেটা ব্যবহার করল, কোত্থেকে বুলেট এলো। এই বুলেট আমেরিকা ও ন্যাটোভুক্ত দেশে তৈরি এবং বাংলাদেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে নেই। মনে রাখতে হবে এ ধরণের বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিভিন্ন ধরণের শক্তির বিভিন্ন ধরণের মোটিভ থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ভিলনুসের গণবিক্ষোভে বেশ কিছু বিক্ষোভকারী গুলীতে মারা যায়। তখন সবাই ধারণা করে যে সেটা মিলিশিয়ার গুলী। তবে এখন জানা গেছে যে সেটা সিআইএ করিয়েছিল নিজেদের লোক দিয়ে। এসব তথ্য পশ্চিমা বিশ্বেই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালের কিয়েভে ভারাটে লোকেরা মিছিলে গুলী করে। প্রথমে ইয়ানুকোভিচের সেনাদের উপর দায় চাপিয়ে বিপ্লব করা হলেও পরে কিয়েভ থেকেই এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। কারণ এসব আন্দোলনে রক্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদি প্রতিপক্ষ রক্ত না ঝরায় তবে নিজেদের সেটা করতে হয়। আসল কথা রক্ত ঝরানো। বিশৃঙ্খলতার মধ্যে কেউ দেখে না কে গুলী করল। দরকার লাশ। সেই লাশ কাঁধে নিয়ে দাবার ঘুঁটি উলটে ফেলা যায়। আর এ জন্যেই দরকার সমস্ত ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত। একমাত্র তাহলেই এই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সবার পরিচয় জানা যাবে। একমাত্র তাহলেই দেশের ভবিষ্যৎ মেঘমুক্ত হবে। আমি এখানে কোন দলের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছি না, বলছি দেশের স্বার্থে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা জরুরি।
ইদানিং ফেসবুকে একটা বিষয় নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। বাংলাদেশে ছাব্বিশ লাখ ভারতীয় কাজ করে বলে আসিফ নজরুল জুলাই মাসের শেষ দিকে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। আন্দোলনের সময় এসব রাজনৈতিক বক্তব্য অনেকেই রাখে। এ নিয়ে নিজের কিছু ভাবনা। আমার এক বন্ধু ঐ প্রসঙ্গ তুলে এই ছাব্বিশ লাখ ভারতীয়ের নাম প্রকাশ করতে বললে লিখলাম সমস্যা ছাব্বিশ লাখে নয়, সমস্যা হল আমাদের দেশের মানুষ এধরণের খবর গোগ্রাসে গিলে। ভারত বিরোধী প্রায় সবই হট কেক আমাদের তথ্য বাজারে। এর উত্তরে একজন জানতে চাইলেন আসিফ নজরুল কোন কথাটা মিথ্যা বলেছেন। তাই মনে হল একটু ভাবা যাক দাবিটি কতটা সত্য আর কতটা মিথ্যা। কারণ এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি অক্ষর গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভারতীয় যে বাংলাদেশে চাকরিরত আছে তাতে ভুল নেই। তবে এখানে সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। এই সংখ্যা দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা হচ্ছে। ২৬ লাখ এটা যে সে সংখ্যা নয়। মনে রাখবেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়। মানে সংখ্যাটি খুবই বড়। এই ভারতীয়রা নিশ্চয়ই বাংলাদেশে কামলা খাটে না বা অড জব করে না। এসব কাজে উপমহাদেশের মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে যায়। তার মানে এরা অফিস কর্মী। এখন সংখ্যাটি একটু ভেবে দেখি। ২৬ লাখ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১ কোটি হলে এটা হত জনসংখ্যার ২৬%, যেহেতু আমাদের জনসংখ্যা সাড়ে ১৭ কোটি, এর মানে সংখ্যাটি জনসংখ্যার ১.৫% এর কাছাকাছি। ধরে নিতে পারি এদের বয়স ২৫ এর বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স ২৫ বছরের নীচে, মানে এই ২৬ লাখ দেশের পঁচিশোর্ধ জনতার ৩%। দেশের এই পঁচিশোর্ধ জনতার এক বিশাল অংশ কৃষি কাজ ও অড জবে জড়িত। সেদিক থেকে বাংলাদেশের উচ্চ ও মধ্য মানের প্রতিষ্ঠান, যেখানে এরা পটেনশিয়ালি কাজ করতে পারে, এই ভারতীয় দিয়ে ভরা থাকত। অর্থাৎ দুবাই, আবুধাবি ইত্যাদি জায়গায় আমরা পদে পদে যেমন উপমহাদেশীয় মানুষ দেখতে পাই বাংলাদেশের অফিস পাড়ায় তেমনি ভারতীয়দের দেখা পেতাম। এটা পরীক্ষা করে দেখা তো কঠিন কিছু নয়। বাস্তবতা কি তাই?
এছাড়া বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পেতে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয়। এরা তো কেউ বিসিএস ক্যাডার নয়। তার মানে এরা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে। আসুন ভেবে দেখি একটু ভিন্ন দিক থেকে। বাংলাদেশ থেকে বিশাল সংখ্যক মানুষ ভারতে যায় চিকিৎসা সেবা নিতে। শুনেছি এমনকি চেন্নাই, ভেলোরের মত জায়গায় বাংলাদেশীদের সেবা দেবার জন্য বিশেষ হোটেল, দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এটা বাংলাদেশীদের ভারত প্রেম নয় বা ভারতীয়দের বাংলাদেশ প্রেম নয়। বাজার অর্থনীতি। সেখানে কম বা সম মূল্যে বেটার সেবা পায় বলে মানুষ সেখানে যায়। কেউ তো জোর করে নিয়ে যায় না। চাকরির ক্ষেত্রে কি সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়? দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষ বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি হয় না বলেই হয়তো শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীরা ভারতীয়দের নিয়োগ দেয়। স্রেফ ব্যবসা। তাই সমস্যা ভারতে নয় সমস্যা বাংলাদেশে। এখন আসিফ নজরুল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা। তার সুযোগ আছে এর সমাধান করার। প্রথমত কথা বলার সময় সততা রক্ষা করা। দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থা এমন করা যাতে দেশের ছেলেমেয়েরাই সেই চাহিদা মেটাতে পারে। তবে সেটা যেন ডিগ্রি সর্বস্ব না হয় আর সেবার মান উন্নত ও জনগণের সামর্থ্যের মধ্যে হয়। জনসভায় বক্তব্য দিয়ে প্রশ্ন করা আর নিজে দায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সমাধান করা এক নয়। আসিফ নজরুল রাজনীতিবিদ নন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে শিক্ষক। তাই এসব ব্যাপারে কোন কিছু বলার আগে একটু ভাবা দরকার। মাত্র কয়েকদিন আগে ভেবে না বলায় শেখা হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল সেটা ভুলে গেলে চলবে না। তবে এটাও হতে পারে তিনি ভারতীয় বলতে বাংলাদেশের হিন্দুদের বুঝিয়েছেন আর তার জের ধরেই এখন চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হিন্দুদের চাকুরিচ্যুত করার উৎসব। শুধু হিন্দুরাই যে চাকরি হারাচ্ছে তা কিন্তু নয়, তবে ২৬ লাখের গর্তটি এমনকি দেশীয় হিন্দুদের হিসেবে নিয়েও ভরা যাবে বলে মনে হয় না।
এখনও হয়তো সময় আসেনি বর্তমান সরকার নিয়ে মন্তব্য করার। তবে ইতিমধ্যে যেসব ঘটনা ঘটছে তা আশার আলো দেখায় না। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা চাইছে অটো প্রমোশন। কিন্তু অটো প্রমোশন হলে মেধাবীদের কী হবে? তারা কোন গ্রেডে পাশ করবে। গ্রেড না থাকলে তারা বিদেশে যাবে কীভাবে, কীভাবে ভর্তি হবে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? বিজয়ের উৎফুল্লতা এক সময় শেষ হবে, এরপর দেখা দেবে ধুসর বাস্তবতা। তখন? শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান জামাতের নাম প্রথম উচ্চারণ করেন। এতে অনেকেই ভ্রুকুটি করেছিল। আমরা তখন শেখ হাসিনার হেফাজত প্রীতি ও মডেল মসজিদ নির্মাণের সমালোচনা করেছি। এখন ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস সকল মসজিদ ও মাদ্রাসায় কারেন্ট বিল ফ্রি করে দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। কওমী জননীর জায়গা দখল করে তিনি কি কওমী জনক হতে চলছেন? আগে সাধারণ ছাত্র বলে পরিচয় দিলেও এখন ধীরে ধীরে সমন্বয়কদের রাজনৈতিক পরিচয় মিলছে যেটা আর যাই হোক বৈষম্যহীন ভাবনার সাথে যায় না। যে কারণে জনমনে হাসিনা সরকারের প্রতি ক্ষোভ জমেছিল সেটা দূর না করে দ্বিগুন বেগে এখন তার চর্চা করা হচ্ছে। একসময় ছাত্র লীগের সদস্যদের দেখা যেত শিক্ষকদের ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করতে, এখন মেধাবী ছাত্ররা সেটা করছে। বাধ্য করা হচ্ছে শত শত শিক্ষককে পদত্যগ করতে, সেখানেও প্রাধান্য পাচ্ছে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী পন্থী শিক্ষকেরা। সবাইকে ঢালাও ভাবে স্বৈরাচারের সহযোগী বলা হচ্ছে। কিন্তু এদেশের অধিকাংশ মানুষই তো গত ১৫ বছর প্রতিবাদ না করেই বসবাস করেছে, কাজ করেছে, পড়াশুনা করেছে সেই সরকারের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে, সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় ভাবে সেই সরকারের ভালো মন্দ সব কাজকর্মে সহযোগিতা করেছে। তাহলে কি আমাদের দেশের সব নাগরিককেই স্বৈরাচারের দোসর বলতে হবে? তাহলে তো হেফাজত সহ অনেক ইসলামী সংগঠনও এর মধ্যে পড়বে। হয়তো এক সেট শিক্ষকের পরিবর্তে আরেক সেট শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে, কিন্তু সেই সেটও নিতে হবে সেই জনতা থেকেই যারা বিগত পনের বছর এসব মেনেই দেশে বাস করেছে। আমরা তো দেখেছি সব জায়গায় রাজনৈতিক ভাবনা থেকে নিয়োগ দিলে তার ফল কি দাঁড়ায়। দেশ আর দল এক নয়। অধিকাংশ মানুষ দেশের কথা ভাবে, দলের কথা নয়। আসলে একজন লোক যদি শুধু সৎ পথে তার কাজটি করে যায় সেটিও দেশের স্বার্থেই যায়।
ধরুন এক গ্রামে দু জন ডাক্তার। তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন ডাক্তার চাইতেই পারে নিজের আয় বৃদ্ধির জন্য অন্যকে কোনঠাসা করে গ্রাম থেকে চলে যেতে বাধ্য করতে। কিন্তু বুদ্ধিমান ডাক্তার জানে একদিন সে নিজেও রোগী হতে পারে। তখন ডাক্তারের অভাবে তার জীবন বিপন্ন। অথবা প্রতিবেশীর বাড়ি দখল করা খুবই লোভনীয়। তবে অনেক সময় রাতে তেলটা নুনটার জন্য বা বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে প্রতিবেশীর গুরুত্ব অপরিসীম, যেমন অপরিসীম বাড়িতে আগুন লাগলে। তবে অধিকাংশ মানুষ এসব ক্রিটিক্যাল অবস্থার কথা ভাবে না, আজকের কথা ভেবে নিজেকে একা করে ফেলে। আমাদের রাজনীতিতে সেটাই ঘটছে বারবার। আমরা রাজনীতিকে প্রতিপক্ষ শূন্য করেছি। ফলে রাজনৈতিক শক্তির কাছে ক্ষমতা হারাইনি, হারিয়েছি তাদের কাছে যাদের কোন ভবিষ্যৎ রূপরেখা ছিল না। আজকের এই অরাজকতার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী বিগত দিনের রাজনীতিহীনতা। বর্তমান ক্ষমতাধররা কি সেটা নিয়ে ভাববে? অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হয় বর্তমানে অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করতে আর এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতেও সে ভুলগুলো এড়াতে। অতীতের ভুল যদি বর্তমানের অন্যায়কে বৈধতা দেয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় তাহলে এই বর্তমান কি আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবে? কখনই পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে। অযাচিত ভাবেই হয়েছে ক্ষমতার পরিবর্তন। না চাইতেই পাওয়া এই সাফল্য মনে হয় শিক্ষার্থীদের পাগল করে তুলেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের পর শুরু হয়েছে শিক্ষক তাড়ানো, পরীক্ষা না দেবার তালবাহানা। মাত্র কয়েকদিন আগে পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছিল, জনজীবন হয়েছিল বিপর্যস্ত। এখন যদি শিক্ষকরা সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন তাহলে পস্তাবে কিন্তু এই শিক্ষার্থীরাই, নষ্ট হবে তাদেরই ভবিষ্যৎ। এই কথাটি শিক্ষার্থীদের বোঝানোর দায়িত্ব কিন্তু অভিভাবকদের। ছোটরা বিপ্লব সফল করেছে, সেটাকে ধরে রাখার দায়িত্ব এখন বড়দের। বড়রা প্রস্তুত কি? একটা ধারণা ছিল সময়ের সাথে আবেগ উপসমিত হবে, পরিস্থিতি শান্ত হবে। প্রথম দিকে পরিস্থিতি কয়েকজন সমন্বয়ক বিশেষ করে ছাত্র প্রতিনিধি নাহিদ ও আসিফের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে মনে হয়েছিল। সেই সাথে ছিলেন আসিফ নজরুল। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ছাত্রদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিলেও এখনও পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের খুব একটা সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। সব কিছু মনে হয় বন্যার জলের মত নিয়ন্ত্রণহীন – চলছে আবেগের জোয়ারে। এই জোয়ার যেন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকে ভাসিয়ে নিয়ে না যায়।
আমাদের দেশে সব আন্দোলনই হয়েছে ছাত্রদের অগ্রনী ভূমিকায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর বড়দের অনৈক্য পরবর্তী পর্যায়ে সেটাকে বানচাল করে দিয়েছে। ১৯৯২ সালে এরশাদের পতনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল পরে সেটা থাকেনি, বরং প্রতিপক্ষকে কীভাবে ধ্বংস করা যায় সে চেষ্টা করেছে। তার ফল বর্তমানের রাজনীতিহীনতা। আজ যখন মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বই পোড়ানো হচ্ছে কোন লেখক তার প্রতিবাদ করছেন না। প্রশ্নটা জাফর ইকবালকে নিয়ে নয়, প্রশ্নটা বই পোড়ানো নিয়ে। তারপরেও কোন ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ দেখিনি। যখন বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছে সেখানেও শিক্ষকগন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করছেন না। একজন শিক্ষক শুধু এক্স ওয়াই জেড নন, তিনি সমস্ত শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি। প্রতিবাদ না করে আপনারা শিক্ষক সমাজের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছেন না তো? কিছু শিক্ষক বিগত বিভিন্ন সরকারের সময়ে হয়তো লেজুরবৃত্তি করেছে, কিন্তু এখন তো সম্মিলিত ভাবে সেখান থেকে ফিরে আসতে পারেন। এসব শিক্ষকদের যদি সরাতেই হয়, সেটা আইনের মধ্যেই হোক। আজ আপনারা নিজেদের ভাগ্য শিক্ষার্থীদের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন। কাল যদি তারা দাবি করে উপাচার্য নির্বাচন করতে হবে ছাত্রদের ভেতর থেকে? সবাই যদি সময় মত নিজের অধিকারের জন্য লড়াই না করি তাহলে এক অভ্যুত্থান থেকে আরেক অভ্যুত্থান পর্যন্ত সুদিনের আশায় দিন কাটাতে হবে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো