বাংলাদেশে ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯: শ্রমিক অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন স্বাধীনতার সংকট -ফজলুল কবির মিন্টু
বাংলাদেশে ইপিজেড (রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) শ্রম আইন ২০১৯ প্রণয়ন করার প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ব্যাপকভাবে খর্ব হয়েছে। এই আইনটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশেষভাবে শ্রমিক সংগঠনের স্বাধীনতা এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকারকে সীমিত করে, যা গণতন্ত্র ও শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯-এর ৯৪(৬) ধারায়, যেকোনো মালিক, যিনি কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত এবং একাধিক ইউনিটের মালিক, তার অধীনে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন করতে বাধ্য। এই ধারার মাধ্যমে, একাধিক শিল্প ইউনিটের মালিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলা হয়েছে। আর, ১১৩(১) ধারার মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠনের জন্য ৫০% শ্রমিকদের সম্মতি আদায়ের শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যা কার্যত ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা ও সংগঠন নির্মাণের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে, ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং এটি শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের শান্তিপূর্ণভাবে সমবায় বা সংগঠিত হওয়ার অধিকার রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-এও উল্লেখ আছে। কিন্তু, ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯-এর ১১৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো শ্রমিক কল্যাণ সমিতি অন্য কোনো ফেডারেশনের সাথে যোগ দিতে বা সংযোগ স্থাপন করতে পারবে না, যা ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে সীমিত করে এবং শ্রমিকদের স্বাধীন সংগঠন প্রতিষ্ঠার অধিকার ক্ষুণ্ণ করে। এই ধারাটি শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত হানে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অপরদিকে, ২২ ধারায় শ্রমিকদের চাকরি থেকে অবিলম্বে বা কোন কারণ ছাড়াই বিতারণের সুযোগ প্রদান করা হয়েছে, যা শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা এবং শোষণের সুযোগ তৈরি করে। মালিক পক্ষকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কোনো স্পষ্ট অভিযোগ ছাড়াই চাকরি থেকে বরখাস্ত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এটি শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্য আচরণ নিশ্চিত করতে বিপজ্জনক, এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের প্রতি শোষণ এবং অবিচারের সম্ভাবনা বাড়ে।
এছাড়া, ৩৪ ধারায় নারী শ্রমিকদের প্রসূতিকালীন চাকরি অবসানে বাধা দেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও, বাস্তবিকভাবে এটি তেমন কার্যকর হয়নি। প্রসূতি নারী শ্রমিকদের জন্য যথাযথ নিরাপত্তা বিধান না থাকা, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারে এবং ইপিজেড শ্রম আইনের এই অদৃশ্যতা নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণকে উৎসাহিত করতে পারে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এ যেসব ত্রুটি ছিল, সেগুলি সমাধান করতে ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছিল, তবে মূল আইনটির দৃষ্টিভঙ্গি এবং কার্যকরী ব্যবস্থাপনায় এখনো বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। একইভাবে, ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯-এর মধ্যে চিহ্নিত ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতাগুলি, বিশেষত শ্রমিক সংগঠনগুলোর স্বাধীনতা, শ্রমিকদের চাকরি নিরাপত্তা এবং তাদের কল্যাণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে কঠিন বাধা সৃষ্টি করছে।
এদিকে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ থাকা সত্ত্বেও আবার ইপিজেড শ্রম আইন তৈরি করা হয়েছে। এক দেশে দুইটি শ্রম আইন থাকার ফলে ইপিজেড এলাকায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য আরেকটি আইন কার্যকর করা হচ্ছে, যা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য শ্রম আইনের সাথে বৈষম্য সৃষ্টি করে। ট্রেড ইউনিয়ন সংশ্লিষ্টরা এ পরিস্থিতিকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন, কারণ এই দ্বৈত আইন ব্যবস্থার ফলে এক শ্রেণির শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য অধিকার এবং সুবিধা পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। এর ফলে শ্রমিকদের মধ্যে বিভেদ এবং বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, যা শ্রমিকদের সংহতি এবং অধিকার রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDA) ৮ নম্বর লক্ষ্য “শোভন কাজ” বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার, ভালো কাজের পরিবেশ এবং সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯-এর এই ত্রুটিগুলি সংশোধন করা হলে, শ্রমিকদের উন্নয়ন এবং শোভন কাজের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি হতে পারে। তাই, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।
লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক