বিজ্ঞান ভাবনা (১৭৯): বিজয়ের মাস -বিজন সাহা
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। তবে এই বিজয় শুধু আনন্দের নয়, বিজয় বেদনারও। ৩০ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম – এটা রাজনীতিবিদদের জন্য সংখ্যা হলেও যারা হারিয়েছে তাদের জন্য এটা সংখ্যা নয়, এক একটি জীবন্ত স্মৃতি যা এসব পরিবার আজও বয়ে বেড়াচ্ছে, ভবিষ্যতেও বেড়াবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। আর সেখানে শুধু গৌরব থাকবে না, থাকবে স্বজন হারানোর বেদনা। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করলেও সারা ডিসেম্বর জুড়েই ছিল একটু একটু করে ভূমি দখলের লড়াই, একটি একটি করে এলাকা শত্রুমুক্ত করার ইতিহাস। তবে বিভিন্ন কারণেই এবারের ডিসেম্বর একেবারেই অন্যরকম। ফলে বিজয় উৎসবও বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন ভাবে এসেছে। বিগত বছরগুলোতে ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের মাস, চারিদিক ছিল উৎসব মুখর। কিন্তু এবার সরকারের পক্ষ থেকেই যেন ম্লান করে দেয়া হয়েছে উৎসবকে, ঠিক যেটুকু না করলেই নয় সেটুকু বা তার কম করে পালন করা। এটা অনেকটা নাস্তিকদের ধর্মীয় রীতি মেনে বিয়ে বা শ্রাদ্ধ করা। তবে এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। শুনলাম মানিক মিয়া এভিনিউয়ে এ যাবত কালের বৃহত্তম কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে আর যেহেতু দর্শক শ্রোতাদের ৮০% তরুণ-তরুণী বা মধ্য বয়সী নারী-পুরুষ তাই অনেকেই আশাবাদী এরাই দেশকে রক্ষণশীলতার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির দিকে নিয়ে যেতে দেবে না। তবে একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে দেশ কোন দিকে এগুবে।
যদিও আওয়ামী লীগের লোকজন শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বলতে বা ভাবতে পছন্দ করে এমনকি তাদের কাছেও এই ভূখণ্ডের ইতিহাস শুরু হয় কমবেশি বিগত শতাব্দীর শুরু থেকে ঠিক যেমন বাঙালি মুসলমানের জন্য আরবের ইতিহাস শুরু হয় ৫৭০ সাল থেকে। একই ভাবে এদেশের আধুনিক সত্ত্বার শুরু ১৯৪৭ সালে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই কি না জানি না তবে এই ভূখণ্ডের সব কিছুই ধর্মের মত ব্যবহৃত হয়। ধর্মের ব্যবহার কীভাবে হয় এখানে? মূলতঃ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। অনেকেই বলে আমাদের দেশের মত রাজনৈতিক উন্মাদনা বিশ্বের আর কোন দেশের জনগণের মধ্যে নেই। তবে সেই উন্মাদনা রাজনীতি সচেতনতা নয়, সেটা কোন না কোন দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন। ফলে রাজনীতি আজ গুণগত ভাবে ধর্মের রূপ পেয়েছে যেখানে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। আর এর ফলে বিভিন্ন জাতীয় দিবস আজ ধর্মীয় উৎসবের মত। এখানে একুশ নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। বই মেলা, লেখালেখি কি না হয়? কিন্তু ভাষার উন্নয়নের জন্য, জাতি যাতে মাতৃভাষায় সঠিক ভাবে ভাবতে, বলতে বা লিখতে পারে সেজন্য কিছু করি না। ঘটা করে স্বাধীনতা দিবস পালন করলেও নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা নির্বিকার। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে বিজয় মেলার আয়োজন করতে পারি কিন্তু বিজয়ের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়া তো দূরের কথা বিজয়ই ধরে রাখতে পারি না। আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি কিন্তু দেশে মুক্ত চিন্তার চাষাবাদ করি না, স্বাধীনচেতা মানুষের বসবাস করার মত যোগ্য পরিবেশ গড়ে তুলতে পারি না। উল্টো দেশকে মেধা শূন্য করার জন্য সব কিছু করি। একাত্তরে হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, স্বাধীন দেশে সবকিছু দলীয়করণ করায় মেধাবী ছেলেমেয়েরা বিদেশে চলে যায় ভাগ্যের অন্বেষণে। আজকাল এসব দিবস জাতির জন্য অনেকটা পাপ করে গির্জায় গিয়ে কনফেশন করার মত। তারপরেও পৃথিবীর আবর্তনে এসব দিবস ফিরে আসবে, ফিরে আসবে স্মৃতি। জাতি স্মরণ করবে তার সূর্য সন্তানদের যাদের তাঁরা মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন এবং আজ তাদের পথহারা হবার দায় তাঁদের নয়।
১৬ ডিসেম্বর – বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছে কোটি কোটি মানুষ। বিজয় শুধু জয়ের আনন্দ নয়, ভয়ের শেষ, নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানোর দিন শেষ, বাড়ি ফেরার, আবার বন্ধুদের দেখা পাওয়ার, বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় স্বজনদের সাথে মিলিত হবার অপেক্ষার শেষ। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, আজ এই বিজয় দিবসের প্রাক্কালেই আবার প্রশ্ন উঠেছে সেই স্বাধীনতা কি স্বাধীনতা ছিল, সেই বিজয় কি বিজয় ছিল? প্রশ্ন আমাকে হতাশ করে না, কেন না একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রশ্ন করা ও তার উত্তর খোঁজাই আমার পেশা। গবেষণা করতে গিয়ে আমরা অহরহ আগের অনেক কাজ বাতিল করি, অনেক কাজ উৎকৃষ্ট করার চেষ্টা করি। এটাই বিজ্ঞানের মূল কথা। কিন্তু সেই সাথে আমরা আগের কাজের উল্লেখ করতেও ভুলি না। এজন্যেই আমরা বলি আমরা আরও দূরে দেখি কারণ আমরা বিশাল বিশাল দৈত্যের কাঁধে বসে আছি। এটাই পরম্পরা, এটাই অতীতের সাথে ভবিষ্যৎকে এক সূতায় বাঁধা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনার কদর কখনোই ছিল না। সব নতুন শাসক নতুন করে ইতিহাস লেখে, সবাই হতে চায় শেষ মেসিয়াহ। কিন্তু এতে করে একাত্তরের তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের মূল্য এতটুকু কমে না, দুই লাখ মা বোনের ত্যাগ এতটুকু ম্লান হয় না। রাজনীতিবিদ আসে, রাজনীতিবিদ যায় কিন্তু একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি দেশ, একটি জাতি, একটি সঙ্গীত, একটি পতাকা কোটি কোটি মানুষের মনে চির অম্লান থেকে যায়।
আমাদের সমস্যা হল আমরা খুব একচোখা। যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। প্রতিটি মানুষের মতই প্রতিটি সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা থাকে। বিগত দিনগুলোতে হাসিনার শুধু স্বৈরশাসন ও দুর্নীতিই ছিল না, অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল। মডেল মসজিদের পাশাপাশি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু ইত্যাদিও এ সময়েই গড়ে উঠেছে। তাই শুধুমাত্র স্বৈরাচারী বলে হাসিনাকে চিহ্নিত করা ইতিহাসের বিকৃতি। কিন্তু এখন বিগত পনেরো বছরের শ্রাদ্ধ করতে গিয়ে আমরা কি একাত্তরকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছি না? জানি একদল লোক মনেপ্রাণে আমাদের বিজয় চায়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় ছিল তাদের পরাজয়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ মানুষ এই বিজয়ের অপেক্ষায় ছিল, তারা রক্ত, কান্না, ঘাম দিয়ে এই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। আজ স্বৈরাচার বা অন্য যেকোনো অজুহাতে একাত্তরের বিজয়কে অস্বীকার করা আসলে যে জনগণের নাম করে ক্ষমতার রদবদল সেই জনগণকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো।
ভারত সরকার ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে ভারতের বিজয় বলায় এবার কিছু অদ্ভুত লেখালেখি দেখেছি ফেসবুকে ও বিভিন্ন গ্রুপে। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই নিয়ে আমরা মনঃক্ষুণ্ণ হতেই পারি কিন্তু উপমহাদেশীয় বা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এটা ভুল কিছু নয়। আগে কখনও এ নিয়ে কোন বাকবিতন্ডা হয়নি। মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল। অন্যদিকে নভেম্বরের শেষে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করলে সেটা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে পরিণত হয়। এটাই ইতিহাস। বিশ্ব শুধু বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্ব আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শুধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই সমাপ্তি ঘটে না, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেরও অবসান হয় আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যতদূর জানি এটা হয় নিয়াজীর উদ্যোগে। কারণ জেনারেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হলেও তাঁর রেগুলার আর্মি ছিল না। সেক্ষেত্রে নিয়াজী অরোরার কাছে আত্মসমর্পন করা সম্মানজনক বলে মনে করেন। তাই ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় উপলক্ষ্যে এই দিনটি পালন করে এতে আমাদের বিজয় প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। বিভিন্ন সময় একাধিক দেশ বিভিন্ন যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং প্রতিটি দেশ নিজের নিজের মত করে দিনটি পালন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাক্তন রিপাবলিকগুলো নিজের মত করেই ৯ মে বিজয় দিবস পালন করে বা করে না। তাই ভারত যদি বিজয় দিবস পালন করে এবং ১৬ ডিসেম্বরকে তাদের বিজয় দিবস বলে এবং এই উপলক্ষ্যে নিজেদের দেশবাসী ও সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানায় এতে ইতিহাসের বিকৃতি হয় না। এতে বাংলাদেশের বিজয়ের মহিমা এক ফোঁটাও কমে না। কেউ কেউ এই ঘটনা ভিন্ন ভাবে দেখার চেষ্টা করছে, বলার চেষ্টা করছে যে এটা আসলে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। ভারত যুদ্ধ করে পাকিস্তান ভাগ করেছে। এরা আসলে মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করতে চাইছে। এটা শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের অবমাননা, আমাদের নিজেদের বিজয়ের গৌরবকে ভূলুণ্ঠিত করা। দুঃখজনক ব্যাপার হল সিপিবির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা সহ অনেক রাজনীতি সচেতন প্রগতিশীল মানুষ কী এক অজ্ঞাত কারণে এসব নন-ইস্যুকে ইস্যুতে পরিণত করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রশ্নের সম্মুখীন করছেন। ইতিহাস থেকে স্বাধীন হতে গিয়ে অনেকেই নিজেদের অন্ধবিশ্বাসের কাছে পরাধীন হচ্ছেন। এখন দেশে অনেকেই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় – জাতির অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলছে। স্বৈরাচার পরবর্তী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আসীন তাদের অনেকের বক্তব্যে মনে হয় বাহান্ন, একাত্তর, শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ এসব বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে পারলেই তারা খুশি। এটা অনেকটা ডালের আগায় বসে ডাল কাটার মত। আমাদের রাজনীতিবিদদের বোঝা উচিৎ অন্ধ আওয়ামী লীগ আর ভারত বিরোধিতা মূলত মৌলবাদীদের হাতই শক্তিশালী করে। দেখবেন আপনাদের এসব পপুলিস্ট স্ট্যাটাস যেন এদের হাতে একাত্তর বাতিলের নতুন অজুহাত না হয়। বিএনপি আর আওয়ামী লীগের হাত ধরে মৌলবাদী শক্তি এক সময় এদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিল, সরকারের অংশ হয়েছিল। প্রগতিশীলদের হাত ধরে তারা সিংহাসনে আরোহণ করেছে ভবিষ্যতে যাতে এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে না হয় সে বিষয়ে এখন থেকেই সতর্ক থাকা দরকার।
আজ কোন কোন উপদেষ্টা বৃহৎ বঙ্গের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এটা খুবই ভয়ানক স্বপ্ন। ইউক্রেনকে ভুলে যাওয়ার দরকার নেই। এসব কথা আসলে এই অঞ্চলকে অস্থিতিকর করে তোলার পাঁয়তারা। কেন? তাতে উত্তেজনা বাড়বে। সেটাকে কেন্দ্র করে চীন ও ভারতের মধ্যেকার সমস্যাগুলো গুরুতর রূপ নেবে। এরা দুজনেই ব্রিকসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ আর ব্রিকস আজ শুধু আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, আমাদের মত দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর হবার জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই কারা এর কলকাঠি নাড়াচ্ছে সেটা বোঝা দরকার। মনে রাখা দরকার এলাকায় উত্তেজনা আমাদের জন্য কোন লাভ নিয়ে আসবে না, লাভবান হবে অন্যেরা। ১৭৫৭ সাল থেকে শিক্ষা নিন। আমেরিকা ব্রিটেনেরই অধস্তন। আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের মতই ব্যবসায়ী। তাদের উত্তরসূরিরা ব্যতিক্রম নয়। ১৭৫৭ সালে একজন মীরজাফর ছিল, এখন হিসেব না করে চললে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে পুরো জাতিটাই মীরজাফর হয়ে যেতে পারে।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো