বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের বঞ্চনা: ইতিহাস, অবস্থা ও অধিকার -ফজলুল কবির মিন্টু
![](https://www.progotirjatree.com/wp-content/uploads/2021/05/Image-263x300.jpg)
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের চা বাগান শিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই শ্রমিকরা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছে, বিশেষ করে ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ১৮৪০ সালের আশপাশে, ব্রিটিশ শাসনামলে চা বাগানগুলির উন্নয়নের জন্য এখানে শ্রমিকদের প্রয়োজন ছিল। তখন থেকেই চা শ্রমিকদের বাংলাদেশে আগমন শুরু হয়। তাদের আগমন সতস্ফুর্ত ছিলনা। বলা যায়, তাদেরকে চা বাগানে কাজ করার জন্য উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে আনা হয়।
প্রথম দিকে, তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং কষ্টকর। ধীরে ধীরে এই শ্রমিকরা এখানকার সমাজের অঙ্গ হয়ে উঠলেও, তাদের অধিকার এবং জীবনমানের উন্নতি আজও হয়নি।
এত দীর্ঘ সময়ে, চা শ্রমিকরা নানান বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসংখ্য সমস্যা রয়েছে -ভূমির অধিকার থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, এবং কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সমস্যাগুলি আজও অমীমাংসিত।
ভূমি ও বাসস্থান:
চা শ্রমিকদের একটি অন্যতম বড় সমস্যা হলো জমি ও বাসস্থানের অভাব। চা শ্রমিকদের নিজের কোনো জমি নেই, এবং অবসরে যাওয়ার পর যে এক টুকরো ভিটেতে তারা বাস করে, সেটিও চা বাগান মালিকদের দেওয়া। এই জমি রক্ষা করতে বংশ পরস্পরায় তাদের পরিবারের একজন সদস্যকে বাধ্যতামূলকভাবে চা বাগানে চাকরি করতে হয়। অন্যথায় তাদেরকে বাসস্থান ছেড়ে দিতে হয়। চা শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছে, অবসরে যাওয়ার পর ভিটেতে অবস্থান করার অজুহাত দেখিয়ে অনেক চা শ্রমিককে শ্রম আইনে প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি থেকেও বঞ্চিত করা হয়। এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, চা শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারগুলির প্রতি মালিক পক্ষ চরম অবহেলা করছে।
এছাড়া, চা শ্রমিকেরা যদি মালিকের জমিতে চাষ করেন, তাহলে জমির আনুপাতিক হারে রেশন কর্তন করা হয়, যা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। এক চা শ্রমিক ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “মালিকরা সরকার থেকে শত শত বিঘা জমি লিজ নিতে পারে, অথচ আমরা যারা এই বাগান গড়েছি, এই বাগানের মাটি ও বাতাসে আমাদের রক্ত-গাম মিশে আছে, আমাদের এক টুকরো জমি কেন থাকবে না?”
চা শ্রমিকদের ভূমি ও বাসস্থান সমস্যা সমাধানের জন্য চা চাষের অনপুযুক্ত শ্রমিক সংখ্যা অনুযায়ী চা বাগানের নামে বরাদ্দ করা হাজার হাজার একর জমির ৫০/১০০ একর সরকারী উদ্যোগে চা শ্রমিকদের নামে মালিকানা দিয়ে ০.১০ (শতক) জমি বরাদ্দ করা উচিত বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে ।
শ্রম আইনে বৈষম্য:
বাংলাদেশের শ্রম আইনে ছুটির বিধান এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের কথা উলেখ আছে। কিন্তু চা শ্রমিকদের জন্য এসব আইনি অধিকার অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, যেখানে অন্য সব সেক্টরের শ্রমিকরা প্রতি ১৮ দিনে ১ দিনের অর্জিত ছুটির অধিকারী হন, সেখানে চা শ্রমিকদের জন্য এই সময়সীমা ২২ দিন করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই বৈষম্য। একইভাবে, চা শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিয়ম যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রেশন ও উৎসব বোনাস:
চা শ্রমিকদের রেশন দেওয়ার সময় মালিক পক্ষ কম দেয়ার জন্য সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বর্তমানে ১২ মাস আটা দেওয়া হয়, যা পূর্বের নিয়মের চেয়ে ভিন্ন। পূর্বে, বছরের অর্ধেক সময় আটা এবং অর্ধেক সময় চাল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। আইন অনুযায়ী একবার দেওয়া সুবিধা আর প্রত্যাহার করা যায় না, কিন্তু এই নিয়মের পরিবর্তন চা শ্রমিকদের জন্য একটি অবিচার।
এছাড়া, চা শ্রমিকরা বছরে ৫২ দিনের উৎসব বোনাস পান। তারা বর্তমানে প্রচলিত ৫২ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনের উৎসব বোনাসের দাবি জানাচ্ছেন, যা তাদের ন্যায্য অধিকার।
প্রভিডেন্ট ফান্ড:
চা শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, তবে তারা যথাযথ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যদিও শ্রম আইনে ৩ মাস চাকরি করার পর শ্রমিককে স্থায়ী করার বিধান রয়েছে, ইদানীং চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি সময় নেয়, ২০-২২ বছর পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ের পর তারা প্রভিডেন্ট ফান্ডের সদস্য হতে পারেন, কিন্তু এর ফলে তাদের অবসরের পর প্রকৃত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
চিকিৎসা সুবিধা:
অধিকাংশ চা বাগানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আইন অনুযায়ী, সপরিবারে সকল চা শ্রমিকদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদান করা বাধ্যতামূলক। কোন বাগানে ৭৫০ জন শ্রমিকের বেশি নিয়োজিত থাকলে, এমবিবিএস ডাক্তার, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ধাই, নার্সসহ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে। তবে এই নিয়মগুলো বহু বাগানে কার্যকর হচ্ছে না। আরও একটি সমস্যা হলো, জটিল রোগে আক্রান্ত শ্রমিকরা যদি সরকারি হাসপাতালে সিট না পান, তবে ক্লিনিকে ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসা বাবদ যে খরচ করতে হয়, তা বাগান কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করে না।
চুক্তি ও শিক্ষা:
ইউনিয়ন এবং মালিক পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে, চা শ্রমিকদের সন্তানেরা যদি শিক্ষিত হন, তবে তাদের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবে, এই প্রতিশ্রুতি মানা হচ্ছে না ফলে চা শ্রমিকদের সন্তানেরা শিক্ষিত হলেও চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি:
চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করার দাবি উঠেছে। বর্তমানে, চা শ্রমিকদের সন্তানরা যদি শিক্ষিত হন, তবে তাদের সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় সুযোগ পায় না। সরকারের পক্ষ থেকে কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ হতে পারে, যাতে তারা সহজেই সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করতে পারে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। তাঁরা একদিকে যেমন চা বাগানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁদের জীবনে নানা রকম বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন। চা শ্রমিকদের ভূমির অধিকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। চা শ্রমিকদের সন্তানের জন্য কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন এবং অন্যান্য শ্রমিকদের ন্যায়বিচার ও সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব। চা শ্রমিকদের বৈষম্য দূরীকরণ এবং তাঁদের অধিকার বাস্তবায়ন করতে সরকার এবং মালিক পক্ষের সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা প্রয়োজন, যাতে তারা তাদের প্রাপ্য অধিকার এবং মর্যাদা ফিরে পেতে পারেন।
(লেখক: বিলস-ডিটিডিএ প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত জাহাজভাঙা শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য কেন্দ্রের সমন্বয়ক এবং টিইউসি কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক)