মতামত

থানায় সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক দালালদের দৌরাত্ম: নতুন বাংলাদেশের পথে এক অদৃশ্য বাধা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু
সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সংঘটিত গণ অভ্যুত্থান দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে নিয়ে এসেছে। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ এক নতুন বাংলাদেশ, ন্যায়ের সমাজ ও সুশাসনের স্বপ্ন দেখেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথপ্রদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তোলা এবং তার ভিত্তিতে আইনের শাসন নিশ্চিত করা।

তবে এই শুভ যাত্রাপথে দেখা দিচ্ছে কিছু অশুভ সংকেত। বিশেষ করে থানার অভ্যন্তরে এবং আশপাশে অল্প কিছু সাংবাদিক নামধারী চক্র (দেশের মূলধারার সাংবাদিকরা নয়) এবং রাজনৈতিক নামধারী দালালদের দৌরাত্ম নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এদের একাংশ নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরীহ নাগরিকদের হেনস্থা করছে। অভিযোগ রয়েছে, এরা পরিকল্পিতভাবে “মব” তৈরি করে বিভিন্ন লোকজনের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবি করে এবং চাঁদা না পেলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার হুমকি দেয়।

এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে যদি যাচাই-বাছাই করে নিরীহ কোনো ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে চান, সেখানেও এই চক্র বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে পুলিশের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা খর্ব হচ্ছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিজেরাই চাপে পড়ে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট

১. আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট

যদি থানাই নিরাপত্তার শেষ ভরসা না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? থানার ভেতরে সাংবাদিক ও দালালদের আধিপত্য থাকলে জনগণের আস্থা কমে যাবে, যা ভবিষ্যতে সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তা

যে কেউ মিথ্যা অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারে — এমন ধারণা সমাজে আতঙ্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এতে করে সামাজিক সম্পর্কেও অবিশ্বাস জন্ম নেয় এবং মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে।

৩. রাজনৈতিক সংকট ও অন্তঃকলহ

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তখনই সফল হবে যখন তার ভিত্তি থাকবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচারের উপর। কিন্তু যদি রাষ্ট্রের আইন ও প্রশাসনই কিছু সুবিধাবাদী মহলের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে, তাহলে নতুন কাঠামো গঠনের পথ হবে অনির্ভরযোগ্য ও বিতর্কিত। এতে করে আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

৪. মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ

সাংবাদিকদের একটা অংশ যদি অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে, তাহলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। যা সংবাদমাধ্যমের উপর জনগণের আস্থা হ্রাস করবে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

উপসংহার

নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় শর্ত হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাই সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দালালদের অপতৎপরতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। থানাকে হতে হবে ভয়ের নয়, আস্থার জায়গা। যারা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই পরিবর্তনের আশা দেখেছে, তাদের হতাশ না করে প্রশাসনকে আরও বেশি স্বচ্ছ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল নতুন বাংলাদেশ গড়া।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)