বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদাহানির ধারাবাহিকতা: কান্তি লাল আচার্যকে মবের চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ
বাংলাদেশে শিক্ষকদের লাগাতার অপমান ও অপদস্থ করার ঘটনা নতুন কিছু নয়, তবে তা এখন যেন একটি নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি হাজি তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে একদল লোকের চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠে এসেছে।
স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এক বিএনপি নেতার সভাপতি হতে না পারার ক্ষোভ থেকেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় বলে দাবি করেছেন শিক্ষক ও স্থানীয়রা। কান্তি লাল আচার্য বলেন, “আমি কোনো অন্যায় করিনি, দুর্নীতি করিনি। কিন্তু আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। এখন জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
তার কন্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভাবনা আচার্য সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্থ হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না। ভাবুন, উনি শুধু শিক্ষক নয়, আমাদের বাবা।”
রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকির অভিযোগ
ঘটনার পেছনে স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরুল আবসারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করা হলেও, তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। ভাটিয়ারি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন ঘটনার সত্যতা অস্বীকার না করলেও এর যৌক্তিকতা দেখিয়েছেন, দাবি করে বলেন, “ওই শিক্ষকের কারণে শিক্ষার মান নষ্ট হচ্ছিল।”
অন্যদিকে, স্কুলের অ্যাডহক ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় জামায়াত নেতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন জানান, শিক্ষককে মব তৈরি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে এবং বিএনপির লোকজন ককটেল ফাটিয়ে ভয়ভীতি ছড়িয়েছিল।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত
সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম জানান, ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, “সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, কাউকে জোর করে পদত্যাগ করানো যাবে না। শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য এখনও দায়িত্বে বহাল আছেন এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্কুলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।”
সারাদেশে শিক্ষক নির্যাতনের চিত্র
শুধু এই একটি ঘটনা নয়, বরং ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই হাজারের বেশি শিক্ষককে একইভাবে মব তৈরি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র। ঢাকা শহরেই এমন ঘটনা ঘটেছে ২০০টিরও বেশি।
শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাব ও বিশ্লেষকদের উদ্বেগ
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “শিক্ষকদের সম্মান বিনষ্ট করার এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি নাগরিক অধিকার হরণের শামিল।”
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, “ছাত্ররা এখন শিক্ষকদের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। নেতাদের মতো করে তারা জোরজবরদস্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ছাত্ররা এখন তাদের সম্মান করছে না। এটা রাষ্ট্রের দুর্বলতা।”
উপসংহার
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে এক গভীর সংকটে। শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, ভবিষ্যতে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।