হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী মারা গেছেন

নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় আমির জুনাইদ বাবুনগরী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহে ……………… রাজেউন)। বৃহস্পতিবার (১৯ আগস্ট) দুপুর পৌনে একটার দিকে চট্টগ্রাম শহরের বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৬৭ বছর বয়সি জুনায়েদ বাবুনগরী দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। জুনায়েদ বাবুনগরীর নামাজে জানাজা ও দাফন নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা কমিটি বৈঠকে বসে। শূরা কমিটি, পরিবার ও হেফাজত নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় জানাজা ও দাফন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর বৃহস্পতিবার রাত ১১ টায় হাটহাজারী মাদ্রাসার মাঠে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। গত ৮ আগস্ট দুপুরে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে গাড়িতে বসে তিনি করোনার টিকার ১ম ডোজ গ্রহণ করেন। হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরীস নদভী বলেন, ‘হুজুর ইন্তেকাল করেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে নিজ কক্ষে বিছানায় শোয়া অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে যান। ডাক্তার এসে অক্সিজেন দিয়ে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার ব্যবস্থা করেন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যাম্বুলেন্সে করে ওনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখনও জ্ঞান ফেরেনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করেছেন। ওনার ডায়াবেটিস বাড়তি ছিল। প্রেশার এবং হার্টের সমস্যা ছিল।’ সিএসসিআর হাসপাতালের সিইও ডা. সালাউদ্দীন মাহমুদ বলেন, গুরুতর অসুস্থ হেফাজত আমিরকে হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিএসসিআর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। মৃত অবস্থায়ই ওনাকে হাসপাতালে আনা হয়। তার কিডনি জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের সমস্যা পাওয়া গেছে।’ সাম্প্রতিক সময়ে নাশকতা, তান্ডব সৃষ্টির উসকানিদাতা জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমেদ শাহ’র হত্যা মামলারও আসামি জুনায়েদ বাবুনগরী। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতের প্রধান ঘাঁটি হাটহাজারী মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক এবং হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফীর মৃত্যুর পর নানা ঘটনার পর বিতর্কিত কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে সংগঠনের নেতৃত্বে আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী। বছরের শেষদিকে ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে নতুন করে আলোচনায় আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। গতবছর নভেম্বরে চট্টগ্রামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হেফাজত আমির জুনায়েদ বাবুনগরী হুমকি দেন, যে কোনো দল ভাস্কর্য বসালে তা ‘টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেওয়া’ হবে। গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতের নেতাকর্মীরা কয়েকদিন ধরে তান্ডব চালায়। সেসব ঘটনার কয়েকটি মামলায় বাবুনগরীকেও আসামি করা হয়। এছাড়া আহমদ শফীর মৃত্যু ‘স্বাভাবিকভাবে হয়নি’ দাবি করে শফীর শ্যালকের করা মামলাতেও আসামি ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। বাবুনগরী ওই তদন্ত প্রতিবেদনকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যায়িত করে আহমদ শফীর মৃত্যু ‘স্বাভাবিক’ হয়েছে বলেছিলেন। হাটহাজারী মাদ্রাসার মুখপত্র মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক মুনির আহমদ বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই বেলা ১২ টায় তিনি মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি জানান, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে বাবুনগরীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে তাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হন সঙ্গীরা। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। অরাজনৈতিক বলা হলেও এই সংগঠনে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও যুক্ত হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠাই হেফাজতের আন্দোলনের লক্ষ্য। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন শাহ আহমদ শফী এবং প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। ২০১১ সালে সরকার ঘোষিত ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’র বিরুদ্ধে মাঠে নেমে হেফাজতে ইসলাম সারা দেশে পরিচিতি পায়। এরপর যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে সেই আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক ব্লগার’ আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তির দাবিতে সক্রিয় হয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি। ১৩ দফা দাবি নিয়ে ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ এবং পরে ৫ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে তান্ডব চালায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এসময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতের শত শত দোকান ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে কওমি শিক্ষার্থীরা। তান্ডবের শিকার হয় আশপাশের অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। সেময় হেফাজতের মহাসচিব পদে থাকা বাবুনগরীর বিরুদ্ধে মারধর, লুটতরাজ ও হত্যার অভিযোগ এনে মতিঝিল থানায়ও মামলা হয়েছিল। এই মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। # ১৯.০৮.২০২১ চট্টগ্রাম #